সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষা ও মাদ্রাসা বিভাগের আওতাভুক্ত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন কর্মসূচী পালন করছে। এই প্রেক্ষাপটে সামনে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম “বাংলাদেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা: বর্তমান পরিস্থিতি ও সংস্কার চিন্তা” শিরোনামে ২৯ জুন, ২০২৫ -এ একটি মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আলোচনায় আরো উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি এবং কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে মূলধারার ব্যবস্থায় একীভূত করার বিষয়ে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টাদের বক্তব্যে সদিচ্ছা প্রকাশ পেলেও, অগ্রগতি হয়নি। উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্যগুলি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে সমর্থন পায়নি, ফলে তরুণদের মধ্যে, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে”। তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ নিম্ন-আয়ের দেশ থেকে মধ্যম-আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। এই সময়ে এসে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে, একইসাথে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষ জনগোষ্ঠী নিশ্চিত করতে হবে। কারিগরি প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া এই উত্তরণ সম্ভব নয়”।
২০২৪ সালে তৃণমূল পর্যায়ে (পঞ্চগড়, সাতক্ষীরা এবং সুনামগঞ্জ), সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর উদ্যোগে, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এর সহায়তায় এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)-এর সার্বিক সহযোগিতায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী, প্রশিক্ষণার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সরকারি কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনের অংশগ্রহণে একটি সামাজিক নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই গবেষণায়, কারিগরি ও বৃত্তিমুলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষাদান পদ্ধতি, এর কার্যকারিতা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কারিগরি শিক্ষায় প্রদত্ত সনদের গ্রহণযোগ্যতা এবং শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থীদের ওপর বিরূপ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কিত বিভিন্ন ইস্যুসমূহ উঠে আসে।
উল্লেখ্য যে, গবেষণার ফলাফলসমূহের ভিত্তিতে গত ২ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ ঢাকায় একটি জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করা হয় এবং এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয় সমীপে সম্প্রতি নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-এর সচিবালয় সিপিডি’র পক্ষ থেকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের প্রস্তাবনা ও সামাজিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ফলাফল সংযুক্ত করে একটি চিঠি হস্তান্তর করা হয়।
বাজেটের অপ্রতুলতার বিষয়ে উল্লেখ করে ড. ভট্টাচার্য বলেন, “জাতীয় বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ উদ্বেগজনকভাবে কম ছিল। গত বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১.৪ শতাংশ। আর এই শিক্ষা বাজেটের ৪.৪ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য। দেশের মাত্র ২৫ শতাংশ বৃত্তিমূলক শিক্ষার শিক্ষার্থী সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়, বাকিরা পড়ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেখানে যথাযথভাবে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছেনা”।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার শিক্ষার্থীদের প্রতি নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে গণমাধ্যমগুলোতেও এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রচারণা নেই”।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বহু বছর ধরে বাংলাদেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে। সংস্কারের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও, উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি, যার ফলে এই খাতটি স্থবির হয়ে পড়েছে। বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বিনিয়োগের অভাব, বরাদ্দকৃত তহবিলের অকার্যকর ব্যবহারের ফলে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে যা শ্রমবাজারের আধুনিক চাহিদা পূরণের জন্য অপ্রস্তুত”।
তিনি আরও বলেন, “দেশে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি খাতের সাথে যুক্ত করে শুধু দক্ষ জনগোষ্ঠীই নয়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারীত্বের একটি কার্যকরী মডেল গড়ে তোলা সম্ভব”।
সমাপনী বক্তব্যে ড. দেবপ্রিয় বলেন, “২০৩০ সালের মধ্যে মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে প্রবেশাধিকার সুনিশ্চিত করা টেকসই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আগামীর রাজনৈতিক ইশতেহারে কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারে স্পষ্ট আলাপ থাকতে হবে”।
Leave A Comment