গৃহীত জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নের চাহিদার মধ্যে প্রায়শই একধরনের ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও স্থানীয় বাস্তবতার এই প্রথাগত টানাপোড়েন বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতার মাপকাঠিতে যাচাই করা প্রয়োজন।   এ প্রেক্ষিতে, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম স্থানীয় পর্যায়ে কয়েকটি নাগরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করে।  এসব পরামর্শ সভা হয় রংপুর (৪ জুন ২০২২), খুলনা (২ জুলাই ২০২২), টাঙ্গাইল (৩১ জুলাই ২০২২), সিলেট (১৩ আগস্ট ২০২২), ঠাকুরগাঁও (২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২), রাঙ্গামাটি (১ অক্টোবর ২০২২) এবং চট্টগ্রামে (২ অক্টোবর ২০২২)।  বাংলাদেশের ২৫টি জেলা থেকে প্রায় ৫০০ এর অধিক নাগরিক পরামর্শ সভাগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং তাঁদের মতামত ও পরামর্শ তুলে ধরেন।  এছাড়া প্রতিটি জায়গায় স্থানীয় সংবাদ কর্মীদের সাথে পৃথক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

এ উদ্যোগেরই ধারাবাহিকতায় এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম- “জন শুনানি: জাতীয় উন্নয়ন এবং স্থানীয় বাস্তবতা” শীর্ষক একটি সম্মেলন আয়োজন করে যা শনিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২২ সকাল ১০.০০ টা থেকে দুপুর ১.০০ টা পর্যন্ত কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি), ফার্মগেট, ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শতাধিক নাগরিক, বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এ জন শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন। এসকল পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের জাতীয় পর্যায়ে দৃশ্যমান করা ও তাদের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষাগুলোকে তুলে ধরাই ছিলো জন শুনানির উদ্দেশ্য।

সম্মেলনের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব মোঃ তাজুল ইসলাম, এম‌পি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের আইন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সাংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর, এমপি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি স্থায়ী সদস্য মিজ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, এমপি। বিভাজিত পর্যায়ের এ ভাবনাগুলো শোনা এবং মূল্যায়নের জন্য নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আরো আমন্ত্রণ জানায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি যাদের নিয়ে একটি বিশেষ নাগরিক প্যানেল গঠন করা হয় এবং এই নাগরিক প্যানেলের সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। এছাড়াও এ জনশুনানিতে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নাগরিকেরা, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন বেসকারী সংস্থার প্রতিনিধিগণ।

সম্মেলনের প্রধান অতিথি মাননীয় মন্ত্রী জনাব মোঃ তাজুল ইসলাম, এম‌পি বলেন যে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। গত ১৪ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ২১০০ ডলার। এছাড়াও তিনি বলেন যে, প্রযুক্তিখাতে সংযোগ বেড়েছে যার ফলে স্থানীয় মানুষের কথা বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন যে, শিক্ষার হার প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে আজ প্রায় ৯০ শতাংশে উপনীত হয়েছে। তিনি মনে করেন স্বাস্থ্যখাতে দুর্বলতা থাকলেও ১৯৯৬ সালে প্রথম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক শুরু করেন স্থানীয় পর্যায়ে যার ধারাবাহিকতা এখনো দৃশ্যমান হয়েছে। তিনি বলেন তিনি একজন মন্ত্রী হিসেবে নয় একজন নাগরিক হিসেবে দুর্নীতি দমন করতে চান এবং সমস্যা সমাধান করতে চান। এ লক্ষ্যে তিনি সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। সবশেষে তিনি বলেন যে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সবার সমবেত হতে হবে, দেশকে ভালোবাসতে হবে এবং কোনো মতামতের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে বিভাজন থাকলেও, দেশ, জাতি এবং ঠিকানার ক্ষেত্রে যেনো কোনো বিভাজন না থাকে।

সম্মেলনের বিশেষ অতিথি মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব আসাদুজ্জামান নূর বলেন যে যে আমরা দেশ হিসেবে অনেক এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন তিনি মঙ্গাপীড়িত অঞ্চল থেকে আসা একজন নাগরিক যেখানে খাদ্যের অভাবে ফাঁসি দিতে হয়েছিলো একজন মুক্তিযোদ্ধাকে। অথচ আজ সে এলাকার তরুণেরা মঙ্গার কথা হয়ত শুধু গল্পেই শুনেছেন। তিনি বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার দুরদর্শিতার সাথে এ দেশকে গড়েছেন এবং এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই এগিয়ে নেয়ার পথে তিনি সবাইকে সমবেতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন সরকার এবং জনগণ আলাদা নয় এবং দায়িত্ব শুধু জনপ্রতিনিধিদের নয়, সরকারের নয়, কাজ করতে হবে সবাই মিলে, এক সাথে গড়ে তুলতে হবে সুন্দর সোনার বাংলাদেশ এবং তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সবাইকে।

সম্মেলনের আরেকজন বিশেষ অতিথি মাননীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘রাজনীতি যখন সুস্থ থাকে, দেশের সব কিছু ঠিক থাকে। আর যখন রাজনীতি অসুস্থ হয়ে যায়, তখন সব অসুস্থ হয়ে যায়।’ তাই তিনি বলেন যে, রাজনীতিকে সুস্থ করতে হবে। তিনি বলেন যারা বিরোধী দলের রাজনীতিতে আছেন তাঁরা সর্বদা ভয়ে থাকেন, বর্তমান সময় কারো জন্যই মসৃণ নয়। তিনি বলেন যে উন্নয়নের কথা আমরা গত ১৫ বছরে অনেক শুনেছি কিন্তু এখনো বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। তিনি মনে করেন সামাজিক সুরক্ষা খাতে টাকা থেকে লুট করা যায়না বলে তা কম। তিনি বলেন প্রান্তিকতা থেকে বের হতে আমাদের লুটের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

সম্মেলন সঞ্চালনায় ছিলেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন,  বাংলাদেশ ক্রমাগতই উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোতে উন্নয়ন হলেও জনগণ এ উন্নয়নের কতটুকু ভাগীদার হয়েছে? তিনি বলেন প্রতিনিধিদের সমস্যা অনুধাবনের মাধ্যমে তথ্য উন্মোচন করার লক্ষ্যে সাতটি অঞ্চলে নাগরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয় যার সার সংক্ষেপ হিসেবেই এই জনশুনিনানি। সেখান থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের সারাংশ হিসেবে তিনি বলেন যে আয় বাড়ছে কিন্তু তার মধ্যে অসমতা বিদ্যমান এবং সকল মানুষের কাছে এ উন্নয়নের ধারা সমানভাবে যাচ্ছেনা। উপ আঞ্চলিক সভা থেকে উঠে আসা বিভিন্ন বার্তা প্রদানের সময় তিনি বলেন যে  যুবসমাজের ক্ষেত্রে শোভন কর্মসংস্থানের অভাবের কথা। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিও পিছিয়ে পড়া মানুষের জনজীবনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টিকে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, নারীদের অবদান সমাজে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও তাদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ হচ্ছেনা। অন্যদিকে পরিবেশ দূষণের এর বিষয়টিকেও ড. দেবপ্রিয় জাতীয় সমস্যা বলে মন করেছেন। তিনি আরো যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করেন তা হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি সেবার যথাপোযুক্ত মানের অভাবের বিষয়টি।

প্রারম্ভিক বক্তব্যের পর পরই শুরু হয় মুক্ত আলোচনা। মুক্ত আলোচনায় সেন্টার ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) এর প্রতিনিধি মোহাম্মদ রাশেদুল আজম বলেন যে, তিনি একজন শারিরীক প্রতিবন্ধী। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রতিবন্ধীদের যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হয়না। তিনি আরো বলেন যে সব অনুষ্ঠানে পরিবর্তনের আশ্বাস দিলেও তা আসলে বাস্তবে সেভাবে দেয়া হয়না। এছাড়াও ২০১৪ সালে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রজ্ঞাপন করা হয় যেটার কোনো প্রচার বা প্রসার সেভাবে নেই বলে বেশিরভাগেরই অজানা থেকে যায়। মোহাম্মদ লিয়াকত আলী বলেন যে, প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর স্বাক্ষর হলেও এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। বাসে তার মত শারিরীক প্রতিবন্ধীদের জন্য সিট বরাদ্দ থাকলেও তারা বাসে ওঠার সুযোগই পাননা, বাস চালকরা প্রতিবন্ধীদের দেখে বাস থামাতে চায়না বলে দাবি করেন তিনি।

নাগরিক প্যানেলের সম্মানিত সদস্য ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি জনাব মনসুর আহমেদ চৌধুরী প্রতিবন্ধী ভাইবোনদের ধৈর্য্য ধারণ করার আহ্বান জানান। তিনি সকলকে ৩১ তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন যে, তিনি ৬৬ বছর ধরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। কিন্তু তিনি একটি অধিকারভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের স্বপ্ন দেখেন, তার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন এবং যাবেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আসা জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বলেন যে তাদের পিছিয়ে রেখে বাংলাদেশ অগ্রসর হতে পারবেনা। সরকারিভাবে আদিবাসীদের হত্যা করা হয়। অন্যদিকে, তাদের জমি সরকারিভাবে বেদখল করে রেখেছে বলেও তিনি দাবি করেন যা তাদের ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। বাংলাদেশ দলিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার ভক্ত বলেন যে, দলিত এবং হরিজন সমাজের একজন প্রতিনিধি বলেন যে, মৌলভীবাজারের কুলাউড়াতে হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুদের স্কুলে ভর্তি হতে দেয়া হয়না। বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে আগত ক্লোডিয়া কেয়া বলেন যে, গারো সম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধি বলেন যে, বর্তমানে শেরপুর, মধুপুর ইত্যাদি অঞ্চলে উন্নয়নের নামে, ইকো-পার্কের নামে গারোদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘উন্নয়নের অন্তরালে আদিবাসীদের কান্না জড়িয়ে যাচ্ছে’। স্বর্ণভূমি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক সারা মারেন্ডি বলেন যে, সাঁওতালদের এবং অন্যান্য আদিবাসীদের ভূমি কমিশন গঠন করে তাদের ভূমির সমস্যা সমাধান করতে হবে। ঠাকুরগাঁও থেকে আসা সাওতাল প্রতিনিধি সেঁজুতি বলেন তাদের এখনো এ সমাজে মানুষ বলেই গণ্য করা হয়না। তাদের সবক্ষেত্রেই অনেক পিছিয়ে রাখা হয়।

আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সম্মানিত নাগরিক প্যানেলে উপস্থিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন যে, আদিবাসীরা এখনো পরিচয়হীনতায় ভুগছেন। এখনো তাঁরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে তাদের একটি বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও তাদের এখনো বাংলাদেশী থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবেই বিবেচনা করা হয় বলে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। নাগরিক প্যানেলের সদস্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আদিবাসী বলি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলি, যাই বলি অথবা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির কথা বলি, এগুলোর চেয়ে বড় বিষয় সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ চা-কন্যা-নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার বলেন যে, রোহিংগঙ্গাদেরও ভূমি অধিকার দেয়া হয় কিন্তু তাদের দেয়া হয়না। তিনি বলেন ‘আমরা নিজ ভূমিতে পরবাসী’। তিনি আরো বলেন যে অসুস্থ থাকলেও তাদের জন্য এ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করা হয়না।

আলোচনায় উপস্থিত সঞ্জীবনী নামে একজন যে, তিনি একজন ট্রান্সজেন্ডার কিন্তু অনেক লড়াই করে তিনি আজ একজন ব্যাংকার। কিন্তু তাদের জন্য কর্মক্ষেত্রে বা সমাজে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যার ফলে ইচ্ছা থাকার পরেও অনেকে এগিয়ে যেতে পারছেনা। আরেকজন উপস্থিত ট্রান্সজেন্ডার প্রতিনিধি বলেন যে, সরকার থেকে তাদের স্বীকৃতি দেয়া হলেও তাদের পরিচয় ভিক্ষাবৃত্তি। তাদের ভোটাধিকার দেয়া হলেও তাদের জন্য আলাদা কোনো লিঙ্গ নেই। নারী অথবা পুরুষ ছাড়া আর কেউ ভোটার আইডি করতে পারেনা বলে তিনি মনে করেন।

মুক্ত আলোচনায় নরসিংদী অঞ্চল থেকে আসা মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম নামে একজন প্রবীণ নাগরিক বলেন যে, যদিও রাষ্ট্রপতির কাছ আশা এসেছিলো যে বয়স্কদের আইডি কার্ড দেয়া হবে বয়স্ক ভাতার জন্য কিন্তু আজ পর্যন্ত সে আইডি কার্ড দেয়া হয়নি। এছাড়াও প্রবীণদের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা নেই বলে তিনি মনে করেন।

গাজীপুর অঞ্চল থেকে আসা রোজিনা আক্তার সুমি বলেন যে, শুধু রাস্তা, ব্রিজ করলেই উন্নয়ন হয়না। এ দেশে এখনো মজুরি আন্দোলন হয় কারণ উন্নয়ন সবটাই পুঁজিবাদীদের পক্ষে যায়, গরীব শ্রমিকদের পক্ষে নয়। পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা এত বছর দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখলেও তাদের পর্যাপ্ত মর্যাদা দেয়া হয়না। আগে ৮০ শতাংশ নারী পোশাক শিল্পে ছিলো কিন্তু তা এখন কমে ৬৫ শতাংশে নেমে গিয়েছে নারীদের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায়।

খুলনার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আসা মেরিনা যুথী বলেন যে প্রান্তিক উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা নিরাপত্তাহীন। সেখানে নারীরা নিজ পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয় যা পর্যাপ্ত নজরে আনা হয়না। যে মৌসুমে সেখানের পুরুষরা কর্মহীন থাকে তখন একই সাথে পরিবারে অর্থকষ্ট এবং নির্যাতন বেড়ে যায়। এছাড়াও এসকল প্রান্তিক অঞ্চলের আবহাওয়ার সাথে লড়াই করে যাওয়া মানুষদের ব্যাপারে বাজেটে কোনো বরাদ্দ নেই বা সরকারি সুযোগ-সুবিধাও কম।

আলোচনায় উপস্থিত শিক্ষার্থীরা বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলেন এবং সেগুলো নজরে আনার জন্য অনুরোধ করেন। ঠাকুরগাঁও অঞ্চল থেকে আসা রণিতা সাহা বলেন যে, বর্তমানে শিক্ষার অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু তরুণরা চাকরি পাচ্ছনা। এছাড়াও অর্থের অভাবে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অনেকেরই পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে পরিবারের চাপে। হাজারীবাগ থেকে আসা রুকাইয়া আহমেদ সাদিয়া বলেন যে, বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রমের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য অনেক শিক্ষার্থীরাই আত্মহত্যা করছে যা সামাজিক উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরুপ। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় সমন্বয় পরিষদের সদস্য আজমাইন হোসেন বলেন যে, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ বিদ্যালয়ের অভাব রয়েছে বিশেষ করে ঢাকার বাইরে। তিনি দাবি জানান, প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা এবং প্রযুক্তিতে অগ্রসর না করলে তাদের পক্ষে এগিয়ে যাওয়াটা সম্ভব নয়। আলোচনায় উপস্থিত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি হীরা বলেন যে, প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য অনেক আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। যদিও আইন আছে প্রতিবন্ধীদের সরকারি পরীক্ষার সময় শ্রুতিলেখক দেয়া হবে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা দেয়া হয়না।

রংপুর থেকে আসা একজন প্রতিনিধি বলেন যে, সাংবাদিকদের জন্য উপজলা পর্যায়ে যে প্রণোদনা যায় তা মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকরা পায়না, শুধুমাত্র পায় সরকারি চাকুরি করা সাংবাদিকরা। এছাড়াও মিডিয়া হাউজে কর্মরত সাংবাদিকদের বেতন বকেয়া থাকে, অথচ সাংবাদিকদের নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। এছাড়াও তিনি রংপুর অঞ্চলের ভাষা সংরক্ষণের জন্য কোনো একাডেমি নেই যার ফলে ভাষাগুলো বিলোপ হয়ে যাচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। কুড়িগ্রাম থেকে আগত সলিডারিটির একজন প্রতিনিধি হারুনুর রশিদ বলেন যে, অন্যান্য অঞ্চলে দারিদ্যের হার কমলেও কুড়িগ্রামে কমেনি যার একটি বড় কারণ সরকারি বিনিয়োগের অভাব। রেল নেই, শিল্পায়ন নেই, কর্মসংস্থান নেই। তিনি বলেন, ‘খাদ্যের মঙ্গা কমলেও, কর্মসংস্থানের মঙ্গা কমেনি’।

নারীপক্ষের প্রতিনিধি মাহমুদা শেলী বলেন যে, জেন্ডার সমতা রক্ষায় জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। তিনি আরো বলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যেসকল সুযোগ-সুবিধা বা ভাতা দেয়া হয় সেভাবে বীরাঙ্গনাদের দেয়া হয়না। যুদ্ধের এত বছর হবার পরেও আজ তারা জনজীর্ন জীবনযাপন পালন করছেন কেউ তাদের দিকে নজর দিচ্ছেনা, এমনকি মুক্তিযোদ্ধারাও না। তিনি বীরাঙ্গনাদের সম্মানের দিক নজর দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নাগরিকেরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ঋণ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন।

নাগরিক প্যানেলের সম্মানিত সদস্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম বলেন যে, নারীদের উন্নয়ন হচ্ছে তা ঠিক কিন্তু তা সমাজের সকল স্তরে যাচ্ছেনা। আর তিনি বলেন আমরা নারী আন্দোলন পুরুষদের পাশে রেখে করতে চাই, তাদের সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।

কমিউনিটি ক্লিনিকের বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে কার্যকারিতার অভাবের কথাও বার বার উঠে এসেছে নাগরিকদের কাছ থেকে। পিরোজপুর থেকে আসা মামুন শেখ বলেন যে, কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সেখানে ডাক্তার পাওয়া যায়না, ওষুধ পাওয়া যায়না। শুধু বড় বড় অট্টালিকাই রয়েছে কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। ধর্মান্ধতা, উগ্রবাদিতা দূর করে একটি অসাম্প্রদায়িক এবং অংশগ্রহণমূলক সমাজ গড়ার স্বপ্নের কথা বলে উন্নয়নের ভাগীদার হবার জোরালো দাবি জানান উপস্থিত নাগরিকেরা।

নাগরিক প্ল্যানেলের সম্মানিত সদস্য সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন যে, প্রান্তিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে সকল ধরনের প্রান্তিকতা থেকে বের হতে হবে। তিনি আরো বলেন, শুধু নীতি করলেই হবেনা, সেবার মান ও উন্নয়ন করতে হবে। এছাড়াও কণ্ঠস্বরকে শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার বলেন যে, এসডিজি অর্জন হলে মানুষের সকল মৌলিক অধিকারই নিশ্চিত করা সম্ভব। কারণ এর প্রতিপাদ্যই হচ্ছে কেউকে পেছনে রাখা যাবেনা। তাই এসডিজিকে স্থানীয়করণের মাধ্যমে এসডিজি অর্জন প্রক্রিয়ায় সবাইকে যুক্ত করতে হবে। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব জনাব মামুনুর রশিদ ও নাগরিক প্যানেলের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন যে, সবাই মিলে কাজ করতে চাইলেও আসলে বাংলাদেশে সে সুযোগটা নেই। সুযোগ থাকলে দেশ আজকে বদলে যেতো এবং তিনি বলেন আমরা সবাই মিলেই সামনে এগিয়ে যেতে চাই। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে আরো বলেন যে দেশ চলে যাচ্ছে কালো টাকার হাতে।

এছাড়াও নাগরিক প্যানেলে উপস্থিত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস বৈষম্যের ইতিহাস। বৈষম্যমূলক উন্নয়নের ইতিহাস। শোষণের কারণে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জনগণ নিজের অধিকার আদায়ের পথ থেকে সরে গেছে। ’সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, ‘সব কিছুতেই আমরা একমত। তবে দু-একটি জায়গায় কথা বলতে হবে। শিক্ষা আইন আলোর মুখ দেখতে না পারার কারণে অনেক কিছু সম্ভব হচ্ছে না। গাইড বই ও কোচিং বন্ধ করা যাচ্ছে না। যা হচ্ছে শুধু আদালতের নির্দেশনায়। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে কেন নেই? এটিকেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে হবে।

বিশিষ্ট ব্যাংকিং ব্যক্তিত্ব জনাব মো. নুরুল আমিন বলেন যে, অন্যান্য অধিকারের মত ঋণকেও অধিকার করতে হবে, কারণ এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে এবং সাবলম্বী হবার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জরুরী। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জনাব কাজল দেবনাথ বলেন যে, ধর্ম বর্তমানে রাষ্ট্র এবং রাজনীতির সাথে মিশে যাচ্ছে যা একান্তই কাম্য নয়। তিনি বলেছেন, ধর্ম থাকবে যার যার ভেতরে কিন্তু রাষ্ট্রের অধিকার সকলের জন্য সমান হতে হবে।

অনুষ্ঠানে নাগরিক প্যানেলের সদস্য হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন সিপিডির-র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান, নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য জনাব নাসিম মঞ্জুর, আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এবং বর্তমানে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সলের সভাপতি জনাব মোঃ নিজামুল হক , দ্যা এশিয়া ফাউন্ডেশনর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জনাব জাকির হোসেন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী, প্রাক্তন সচিব ও নারী নেত্রী ডা: মাখদুমা নার্গিস, সঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, বাংলাদেশ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি জনাব নির্মল রোজারিও, মাদারীপুর লিগাল এইড এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ফজলুল হক, প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক জনাব সোহরাব হোসেন এবং টাঙ্গাইল ল কলেজের অধ্যক্ষ জনাব খান মোহাম্মদ খালেদ। ৩ও

সম্মেলনের শেষে সভাপতি প্রফেসর রেহমান সোবহান বলেন যে, স্থানীয় আলোচনা এবং জাতীয় আলোচনার মধ্যে সর্বদাই একটি পার্থক্য থাকে। মাঠ থেকে যে আলোচনা আসে তার সাথে বড় পর্যায়ের আলোচনার সাদৃশ্য থাকেনা। তিনি মনে করেন মাঠ থেকে কথা তুলে আনার দায়িত্ব সরকারের। বছরের পর বছরের একই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে কিন্তু এর সমাধান হচ্ছেনা কেনো সেদিকে নজর দিতে হবে। তিনি সুপারিশ করেন যে, যেসব প্রশ্ন আসছে স্থানীয় পর্যায় থেকে সেগুলোকে বিবেচনা করতে হবে, স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগের দুরত্ব দূর করতে হবে। সর্বোপরি তিনি মনে করেন যে সমস্যা সমাধানে সব পর্যায়ে দায়িত্ব বণ্টন করতে হবে এবং এ দায়িত্ব বণ্টন করতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

সম্মেলনের ছবি দেখতে এইখানে ক্লিক করুন