বাংলাদেশে কৃষিখাতে যতখানি উন্নতি হয়েছে, ততখানি কৃষকের উন্নতি হয়নি। অন্যদিকে উৎপাদনের প্রাক্কলনেও সমস্যা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে রক্ষ্যা করাই এই খাতে মূল চ্যালেঞ্জ। আগামী বোরো ধান চাষের পরবর্তী সময়ে খাদ্য পরিস্থিতিকে নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। বর্তমানে চালের বাড়তি দাম যেন উৎপাদকের কাছে পৌঁছাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, চালের দাম যেন নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি না করে তা খেয়াল রাখতে হবে। কৃষক, কৃষি খাতের সাথে যুক্ত সকল পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি “কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন”- এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্ষেপণ এবং স্বল্প-মধ্য মেয়াদে দাম নির্ধারণ করা সহজ হবে। এই কমিশনের মাধ্যেম বাজার সংকেত পাবে, নীতি নির্ধারকরা পদক্ষেপ নিতে পারবে এবং গবেষণাকে কার্যকরভাবে উৎপাদনের সাথে যুক্ত করা যাবে।

এ সকল মন্তব্য উঠে আসে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে আয়োজিত “চালের দাম বাড়ছে কেন? কার লাভ, কার ক্ষতি” শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপে। সংলাপটি রবিবার, ১০ জানুয়ারি ২০২১ অনুষ্ঠানটি হয়।

এসডিজি প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংলাপের সভাপতিত্ব করেন এবং বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের সঠিক প্রাক্কলনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করব বলেন, এই প্রাক্কলনের উপর ভিত্তি করেই নীতি নির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তিনি আরও বলেন যে, সরকারের দান-চাল মজুদ করার সক্ষমতা কম হওয়ায় কারণে বেশিরভাগ সময়ই সরকারের পক্ষে  বাজার প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে না। এছাড়াও তূলনামূলক ছোট কৃষকের কাছে থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করতে হবে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন যে ছোট ও মাঝারী কৃষকের টিকে থাকার সক্ষমতা কম, তাই তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও হাওড় অঞ্চলের মোট নয়টি জেলা (গাইবান্ধা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, মেহেরপুর, নীলফামারি, রংপুর, সিরাজগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম) থেকে প্রায় ৪০ জন কৃষক, কৃষাণী এবং কৃষি ব্যবসার সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এই সংলাপে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন।  তারা বলেন যে, মিল মালিকরা আগেই ধান কিনে মজুত করে রাখে, যে কারণে চালের দাম বাড়লেও কৃষক তার মূল্য পায় না। ধান চাষে খরচের তুলনায় কম দামে বিক্রি করতে হয়, তাই কৃষক ধান চাষ থেকে সরে আসছেন। তারা আরও বলেন যে, সরকার যে ধান সংগ্রহ করেন সেখানে সবাই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তাই কম দামে মিল মালিকের কাছে বিক্রি করতে হয়।

জনাব মুহাঃ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, এমপি, সদস্য, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সংলাপের বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কৃষি খাতে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ভর্তুকি ও উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন এবং বলেন যে এই সকল সুবিধা কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে।

ধান চাষে লাভবান না হওয়ায় ধানের উৎপাদন ক্রমাগত কমছে বলে মনে করেন জনাব শাইখ সিরাজ, পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই। কৃষি খাতে অনেকে ধান চাষ থেকে উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় এবং চাষযোগ্য জমি কমে আসায় ধান চাষের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, সরকারি গুদামে ছোট কৃষকদের ফসল সংরক্ষণ করার সুযোগ করে দিতে হবে যেন ফসলের সাথে সাথে কৃষককে অল্প দামে ফসল বিক্রি না করতে হয়।

বাজারে চালের দাম বাড়লেও এই বাড়তি দামের কারণে কৃষক লাভবান হয়না বলে মনে করেন ড. এম আসাদুজ্জামান, সাবেক গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইস্টিটিউট (বিআইডিএস)। তিনি বলেন যে, কৃষক অনেক আগেই কম দামে ধান বিক্রি করে দেয়। ড. কাজী শাহাবুদ্দিন, সাবেক মহাপরিচালক, বিআইডিএস সম্মানিত প্রারম্ভিক বক্তা হিসেবে বলেন যে, সরকারের বর্তমানে খাদ্যশস্য মজুত পর্যাপ্ত নয় এবং এটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জনাব কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন যে, সরকার প্রকৃত কৃষকের থেকে চাল না কিনে মিলারদের থেকে ক্রয় করছে, তাই কৃষক উপকৃত হচ্ছে না। মিলারদের ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মজুতদারির কারণে বাজারে চালের অপর্যাপ্ততার কথা তুলে তিনি বলেন যে, প্রতিবছর বাম্পার ফলনের পরেও চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। সরকারকে স্থানীয় পর্যায়ে ক্রয় কেন্দ্র করে সরাসরি কৃষক থেকে চাল ক্রয় করার পরামর্শ দেন তিনি। বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স এসোসিয়েশন-এর সভাপতি, জনাব একেএম খোরশেদ আলম খান বলেন যে, মিলাররা মৌসুমের শুরু থেকেই কৃষকদের থেকে ১,০৫০ টাকায় ধান ক্রয় করেছে। চালের এই বাম্পার ফলনের কথার সাথে দ্বিমত করে তিনি বলেন যে- এই মৌসুমের শুরু থেকেই সরবরাহ কম ছিল।

বাজারে চালের পর্যাপ্ততা নিয়ে বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি জনাব শাহ আলম বাবু বলেন চালের আমদানি শুল্ক কমানো হলেও, সঠিক সময়ে এই নীতি গ্রহণ না নেওয়ায় সেই পরিমাণ চাল আমদানি করা যায়নি। ধান ও চালের তথ্য বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের  মহাপরিচালক ড. মোঃ শাহজাহান কবির উৎপাদনের ভুল প্রাক্কলন নিয়ে সংলাপে উপস্থিত বক্তাদের মন্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ  করে বলেন- উৎপাদনের প্রাক্কলন সঠিক ছিল  এবং তিনি খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন না। সংলাপে ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এবং ড মোঃ নাজিরুল ইসলাম, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সিটিউট ও বক্তব্য রাখেন।

সংলাপে জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, কৃষি বিষয়ক সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আড়তদার, চাল ব্যবসায়ী, চালকল মালিক অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত ও মন্তব্য তুলে ধরেন।