Published in প্রথম আলো on Monday 1 October 2018
নাজিয়া হোসেন
জন্মটা একটা দুর্ঘটনাই ছিল। কারণ, তাঁর জন্ম হয়েছিল টয়লেটে। মেঝেয় আঘাত লেগে মাথায় তৈরি হয় গভীর ক্ষত। তাঁর বেঁচে থাকার আশাই ছেড়ে দেন সবাই। কিন্তু প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে যান তিনি। মা তাই নাম রাখেন জীবন। পুরো নাম জীবন উইলিয়াম গোমেজ। প্রাণে বাঁচলেও জীবন শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যান।
লড়াই করে প্রাণে বেঁচেছেন। তাই মা-বাবা জীবনকে লড়াই করতে শিখিয়েছেন। নিজেরাও সঙ্গী হয়েছেন সন্তানের লড়াইয়ে। জীবন বলেন, ‘আমি তখন বসে থাকতেও পারতাম না। পড়ে যেতাম। তাই মা বাড়িতে নিজে ও শিক্ষক রেখে প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। তারপর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন। বাবা তিন চাকার বেবিসাইকেল কিনে দিলেন। মা প্রতিদিন বাঁ হাতে আমাকে কোলে করে ডান হাতে সাইকেলটা নিয়ে স্কুলে দিয়ে ও নিয়ে আসতেন। তপ্ত রোদে মায়ের ঘাম ঝরত। কখনো চোখের পানিও। কিন্তু এক হাতে আমি, আরেক হাতে সাইকেল বলে মুছতে পারতেন না! তখন আমি কী বলে মাকে সান্ত্বনা দিই খুঁজে পেতাম না। শুধু বলতাম, দেখো মা, লেখাপড়া করে একসময় আমি বড় হব! মায়ের কান্না আর বাঁধ মানত না। সাইকেল রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, “তা–ই যেন হয়, বাবা! তুমি এমএ পাস করবা!’ আমার মায়ের সে চোখের পানি আর সব সময় ওই একই কথা ‘তুমি এমএ পাস করবা’। সেটিই ছিল আমার প্রেরণা।’
জীবন এবার বলেন তাঁর বাবার কথা। বলেন, ‘বাবা বলতেন মনোবল ঠিক থাকলে সবই সম্ভব! মূলত, আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব আমার মা। আর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক আমার বাবা। তাঁরা আমার মাঝে যে অনুপ্রেরণার আলো জ্বালিয়েছেন, সেটাই আমাকে এগিয়ে যেতে শক্তি জোগায়। পরিবেশ যত প্রতিকূল হয়, সমস্যা যত জটিল হয়, আমি ততই নিজের উদ্যম বাড়িয়ে দিই! আমি মনে করি, পরিবার থেকেই এভাবে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি জাগিয়ে দেওয়া উচিত। পরবর্তী জীবনে আমার সব বন্ধু, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সহকর্মী—সবাই বাকিটুকু এগিয়ে দিয়েছেন!’
একটি নয়, জীবন দুটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। একটি হলো উন্নয়ন অধ্যয়ন আরেকটি মনোবিজ্ঞান। জীবন¯২০ বছর ধরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন। তবে শুরুটা ছিল আরও আগে। ১৯৯৩ সালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। তিনি বর্তমানে টার্নিং পয়েন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। এ ছাড়া তিনি বিশ্বব্যাংক, অ্যাবিলিস ফাউন্ডেশন, হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল, কারিতাস, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল ও এসএআরপিভিতে কাজ করেছেন। তিনি সারা দেশে তৃণমূল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলোর (ডিপিও) সক্ষমতা বাড়ানো ও কারিগরি সহায়তা দেওয়ার কাজ করেন। তৃণমূল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠিত, অংশগ্রহণ, অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করেন। তিনি জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক সনদের আলোকে (ইউএনসিআরপিডি) সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় পরিবীক্ষণ কমিটির একজন সদস্য। জীবন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড ও ভারতে পেশাগত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছেন।
লেখালেখির জন্য জীবন বিশপ টি এ গাঙ্গুলী সাহিত্য পুরস্কার ২০০১ অর্জন করেছেন। চমৎকার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে ফিনল্যান্ডের অ্যাবিলিস ফাউন্ডেশন প্রশংসাপত্র পেয়েছেন।
জীবন মনে করেন, অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হলে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে সক্ষম। বাকি ১০ ভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আবাসন ও ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকারের। তাহলে তাঁদের অভিভাবকেরা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা ও সামর্থ্য আছে।
জীবন আরও বলেন, ‘কিছু কিছু প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, তাঁরা যেন কিছুই করতে পারেন না। অথচ তাঁরা না থাকলে আমাদের সংগঠন টার্নিং পয়েন্ট প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা থাকত না।’
এমনই একজন ভিনসেন্ট। টার্নিং পয়েন্টের চেয়ারম্যান ডমিনিক রোজারিওর একমাত্র ছেলে। শোনা যাক ভিনসেন্টের কথা।
ডমিনিক রোজারিও বলেন, ‘আমাদের চার সন্তানের মধ্যে রুমলে ভিনসেন্ট রোজারিও দ্বিতীয়। তার জন্ম হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৫ মে। জন্মের পর সে স্বাভাবিক ছিল। ছয় মাস বয়সে প্রচণ্ড জ্বর এবং খিঁচুনি হয়ে প্রায় নিস্তেজ হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রতিবন্ধী। ৪১ বছর ধরে সে আমাদের পরিবারে একজন শিশু। তার সব কাজ মা-বাবাকেই করতে হয়। সে পুরোপুরি অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আপাতদৃষ্টিতে সে কিছুই করতে পারে না। সমাজে ওর কোনো অবদান নেই।’
ডমিনিক আরও বলেন, ‘একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝতে পারব, ভিনসেন্টকে দান করার জন্য সৃষ্টিকর্তা আমাদের বেছে নিয়েছেন। এই উপলব্ধি আমাদের জীবনের সবকিছুতে একধরনের পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ৪০ বছর ধরে ভিনসেন্টকে শিশুর মতো করে লালনপালন করতে গিয়ে আরও অভিজ্ঞ, আত্মপ্রত্যয়ীও পারদর্শী হয়ে উঠেছি। গভীরভাবে ভাবতে শিখেছি। অন্যদের বুঝতে পেরেছি। হতাশাগ্রস্ত পরিবারকে মনের শক্তি জোগাতে পেরেছি।’
ডমিনিক বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯৯৩ সাল থেকে অল্প পরিসরে কাজ শুরু হয়েছে। ভিনসেন্ট এমন না হলে আজকে জীবন নামের এই প্রতিবন্ধী ছেলেটির সঙ্গে পরিচয়ও হতো না। টার্নিং পয়েন্টও হয়তো হতো না। তার মানে ভিনসেন্ট নিজে কিছু করতে না পারলেও আমাদের অনেক কিছুই করতে উৎসাহ দিচ্ছে। ওকে আমাদের অনুপ্রেরণার মূলে রেখে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে।’
টার্নিং পয়েন্ট জাতীয় পর্যায়ে কর্মরত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন (ডিপিও)। টার্নিং পয়েন্টের আনুষ্ঠানিক শুরু ১৫ জানুয়ারি ২০১০। ২০১২ সালের মার্চে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি এবং ২০১৪ সালের জুলাইয়ে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর নিবন্ধন লাভ করে। ‘সফলতা অর্জন করতে হলে জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, মানুষ চেষ্টা করলেই তার জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে’—এই বিশ্বাস থেকেই সংগঠনের নামকরণ হয়েছে ‘টার্নিং পয়েন্ট’। সংস্থার সাধারণ ও কার্যনির্বাহী দুই পরিষদেই ন্যূনতম ৫০ ভাগ ব্যক্তির সদস্যপদ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের পূর্ণ অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা গঠনতন্ত্রে রয়েছে। সংগঠনের কর্মীদের বেশির ভাগই প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী নারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেকেই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। অনেকেই তাঁদের নতুনত্ব ও গুছানো কাজের প্রশংসা করেন।
টার্নিং পয়েন্টের স্বপ্ন, বৈষম্য ও বঞ্চনাহীন এমন একটি সমাজ, যেখানে প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধী প্রত্যেক মানুষেরই নিজ নিজ প্রতিভা ও সক্ষমতা অনুসারে পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ থাকবে। সমাজে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ অবদান রাখার ক্ষেত্রে সমঅধিকার, সমঅংশগ্রহণ ও সমসুযোগ থাকবে।
টার্নিং পয়েন্ট বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ আয়োজন করে। যেমন: বাংলা ইশারা ভাষা, প্রকল্প পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা প্রণয়ন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিশেষত প্রতিবন্ধী নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার, তৃণমূল ২০টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন (ডিপিও) সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক কাজ, যেমন: ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিকস ডিজাইন ও প্রশিক্ষণ। এ ছাড়া আরও নানা কর্মসূচি রয়েছে এই সংগঠনের।
কর্মীরা বলেন, টার্নিং পয়েন্ট প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিপূর্ণ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে না। কাজে নতুন কোনো দক্ষতার প্রয়োজন হলে বাইরে থেকে পরামর্শক না নিয়ে কর্মীরা নিজেদের দক্ষতা বাড়ায়। যেমন টার্নিং পয়েন্টের কোনো কমপিউটারে সমস্যা হলে আর বাইরের কাউকে আনতে হয় না। নিজেরাই ঠিক করে নিতে পারে। একই ভাবে সংগঠনের ওয়েবসাইট তৈরি করা হয় নিজেরা শেখার পর। কোনো প্রকল্প প্রস্তাবনা বাইরের কোনো পরামর্শক দিয়ে লেখানো হয় না। অন্যদেরটা লিখেও দেওয়া হয় না। প্রয়োজনে শিখিয়ে দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ সহায়িকা, বিভিন্ন প্রকাশনাও নিজেরাই তৈরি করে। ২০১৯ সালের শুরুতে ওয়েবসাইট উন্মুক্ত করে দেওয়ার কাজ চলছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে জীবন বলেন, সংগঠনের বিকাশকে কেউ কেউ চারটি পর্যায়ে ভাগ করে থাকেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত বর্তমান কার্যক্রমগুলোই অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে মান উন্নয়ন ও শিক্ষা অর্জনের দিকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে ২০১৯ সালের শুরু থেকে। ২০২১ সাল থেকে টার্নিং পয়েন্ট কেবল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নয়, বাংলাদেশের বৃহত্তর যুবসমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে কাজ করবে।
জীবন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা বিভিন্ন সভা, সেমিনার, গোলটেবিলে সীমিত রাখতে চান না। বাস্তবে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চান। জীবন বলেন, একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষক যদি ছাত্রদের ভালোভাবে পড়ান কিংবা ভেজালমুক্ত রুটি-বিস্কুট-কেক তৈরি করে বিক্রি করেন, মানুষ তাঁকে সহজেই আপন করে নেবে। সে জন্য আলাদা করে কিছু করার প্রয়োজন নেই।
লেখক: দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাংবাদিক