বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বৈষম্য বিরোধী বিল ২০২২ উত্থাপন করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুদিন ধরেই এমন একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মাসে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত নাগরিক সম্মেলনের ঘোষণাপত্রেও এই আইনের দাবি করা হয়েছিল। বৈষম্য বিরোধী যে বিল সংসদে উত্থাপিত হয়েছে তা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ, ১০ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে একটি মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে। মিডিয়া ব্রিফিংয়ে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যারা এই আইন উত্থাপনে জনমত তৈরিতে যুক্ত ছিলেন, তারা বক্তব্য রাখেন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ তার সূচনা বক্তব্যে বলেন যে, বহুদিন ধরেই নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও তাঁর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো এই আইন উত্থাপনে ও খসড়া প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করে আসছে। ২০১৭ সালে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সম্মেলনের একটি ঘোষণাপত্রেও এই আইন উত্থাপনের দাবী করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে, সংবিধানের মৌলিক ধারাগুলোর উপর ভিত্তি করেই এই আইনটি উত্থাপন করা হয়েছে। তবে, এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্যে দৃশ্যমান রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন ও নাগরিক নজরদারি প্রয়োজন।
মিজ শাহীন আনাম, কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, সভা প্রধান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জনবান্ধব, বিশেষত এমন নারীবান্ধব আইন উত্থাপনের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানান এবং বলেন এই আইন উত্থাপন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের কথা তিনি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০০৭ সালে প্রথম এর কাজ শুরু হয় এবং লক্ষ্য করা হয়, বৈষম্যকে সুনিদির্ষ্টভাবে লক্ষ্য করে কোন আইন নেই। পরবর্তীতে জনমত জরিপের মাধ্যমে ২০১৩ সালে আইন কমিশনে খসড়া জমা দেওয়া হয়। এখন এই আইনটি জনগণের প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে সেজন্যে সঠিক মনিটরিং কমিটি প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জনাব জাকির হোসেন, বলেন, ঢাকায় বসে প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে কি ধরণের বৈষম্য চর্চা হয়, সেটা বোঝা খুব কঠিন। উত্থাপিত আইনে সুস্পষ্টভাবে কোন শাস্তির বিধান রাখা হয় নেই। এক্ষেত্রে আইনে সুস্পষ্ট শাস্তির বিধান থাকা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে মনিটরিং কমিটির মেয়াদ ২ বছরের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হওয়া যেতে পারে।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) বলেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী (যেমন- হিজড়া, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু) তাদের বিরুদ্ধে হওয়া বৈষম্যের ব্যাপারে জানিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে একটি আইনের মাধ্যমে সব ধরণের বৈষম্যকে কেন্দ্রীভূত করার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে, আইনে বৈষম্যের সংজ্ঞায় এখনো কিছু সমস্যা আছে। যেমন – যৌনকর্মীদের পেশা বৈধ কি না; এ ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, বৈষম্যের প্রতিকার কিভাবে হবে সেটা এই আইনে স্পষ্ট নয়। তাছাড়া, রাষ্ট্রের অনেক আইনেই বৈষম্যমূলক ধারা আছে। যেমন – সাক্ষ্য আইনের মাধ্যমে ধর্ষিতার চরিত্র হনন, একজন নারীর কাজী না হতে পারা কিংবা প্রতিবন্ধিদের বিসিএস বা জুডিশিয়াল সার্ভিসে সক্রিয়ভাবে যোগদানের সীমাবদ্ধতা। তাছাড়া, মনিটরিং কমিটির ক্ষমতা, কার্যব্যপ্তি এবং স্বাতন্ত্র্য নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
ড. ফস্টিনা পেরেইরা, সিনিয়র ফেলো, সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস এবং প্রফেসর, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি বলেন, প্রতিকারের জায়গাটা আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত। যেমন – একজন ব্যক্তি একের অধিক ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি কী ধরণের প্রতিকার পাবেন, সেটা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া, উত্থাপিত আইনে অভিযোগ দায়ের থেকে শুরু করে সবশেষে প্রতিকার পেতে একধরনের প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতা লক্ষ্যণীয়। একজন ক্ষতিগ্রস্ত নিজ থেকে অভিযোগ দায়ের করার আগেই ক্ষতিগ্রস্তের জন্যে রাষ্ট্রকে নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্যোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
রাজনৈতিক শূণ্যতার প্রেক্ষিতে বর্তমানে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার ব্যপ্তি ঘটানোর জন্যেই সব ধরণের আইন প্রণিত হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট-এর আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি উত্থাপিত আইনে প্রতিকারের জন্যে যে মনিটরিং কমিটিগুলোর কথা উল্লেখ আছে, তাদের কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মনে করেন, অনেকক্ষেত্রেই এই ধরণের আইনে মনিটরিং কমিটি গঠিত হলেও, তাদের কোন ধরণের সভা অনুষ্ঠিত হয় না। ফলে, আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দেখা যায় না।
ড. ইফতেখারুজ্জামান, কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেন, বৈষম্যের কাঠামোগত সংজ্ঞায়নে মানসিক প্রতিবন্ধি, বর্ণ বৈষম্য ও এসিডদগ্ধদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ। তাছাড়া, এই আইনে ভূমির আইনগত মালিকদের কথা বলা হলেও, প্রথাগতভাবে ভূমির মালিকদের তথা আদিবাসীদের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আইনের বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতি আলোকপাত করে তিনি উল্লেখ করেন, একটি বৈষম্য বিরোধী কমিশন গঠন করার মাধ্যমে উত্থাপিত আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটা দেখা জরুরি।