বাংলাদেশের আদালতগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৪২ লাখ মামলা বিচারাধীন আছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ মীমাংসায় গ্রাম আদালতের এখতিয়ার ৩ লাখ টাকায় উত্তীর্ণ হলেও পৌর বোর্ড আইনের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি এখনও ২৫ হাজার টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আদালতে সালিশ বা আপসযোগ্য বিরোধগুলো নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি, হয়রানি ও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বিচারপ্রার্থীদের।

‘বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন ২০০৪ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা’ শিরোনামে ২৯ মে ২০২৪ -এ একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারটি আয়োজিত হয় মাদারীপুর লিগাল এইড এসোসিয়েশন (এমএলএএ), মিউনিসিপ্যাল এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ম্যাব), দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন-বাংলাদেশ এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এর উদ্যোগে।

সেমিনারটির সভাপতিত্ব করেন মাদারীপুর লিগাল এইড এসোসিয়েশন (এমএলএএ) এর সভাপতি এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব মোঃ তাজুল ইসলাম, মাননীয় মন্ত্রী, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাদারীপুর লিগাল এইড এসোসিয়েশন (এমএলএএ) এর প্রকল্প সমন্বয়ক এডভোকেট মোহম্মদ ইব্রাহিম মিয়া। সহ-আয়োজক হিসেবে বক্তব্য রাখেন এডভোকেট খান মোহাম্মদ শহীদ, মাদারীপুর লিগ্যাল এইড এসোসিয়েশন (এমএলএএ) এর প্রধান সমন্বয়কারী, মিউনিসিপ্যাল ​​অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমএবি) সেক্রেটারি জেনারেল এবং মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র জনাব মোঃ খালিদ হোসেন ইয়াদ এবং জনাব কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ, কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ, এশিয়া ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র জনাব জাকিয়া খাতুন ও সাভারের মেয়র জনাব আলহাজ্ব মুহাম্মদ আব্দুল গনি। বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন) জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান।

সভাপতির বক্তব্যে ড দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আশা করি খুব দ্রুততার সাথে এ আইনের সংশোধন হবে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার পাওয়া নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে পৌর বোর্ড আইনটি সংশোধন এখন সময়ের দাবি।

পৌর এলাকার জনগনের দূর্দশা উল্লেখ করে জনাব খান মোহাম্মদ শহীদ বলেন, স্থানীয়ভাবে বিরোধ মীমাংসা আরো শক্তিশালী হওয়া দরকার। বিরোধ মিমাংসার এই বর্তমান আইনটি সংস্কার করা জরুরী যেন বাংলাদেশের পৌরসভায় বসবাসকারী পাঁচ কোটি মানুষকে ক্ষুদ্র বিবাদ মিমাংসার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে না হয়।

জনাব খালিদ হোসেন ইয়াদ বলেন, আইনে উল্লেখ না থাকলেও ভিত্তিহীন বা স্থানীয়ভাবে মিমাংসাযোগ্য মামলাগুলোর তদন্ত করতে আদালত থেকে পৌরসভাকে নির্দেশ দেয়া হয়। স্থানীয় পরিষদগুলো কাজ না করলে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যেত। তাই তৃণমূল পর্যায়ের সুপারিশ অনুযায়ী স্থানীয় পর্যায়েই বিরোধগুলো মীমাংসা করার জন্য সীমাবদ্ধতা ২৫ হাজার টাকা থেকে ১০ লক্ষ টাকায় উত্তীর্ণ করা উচিৎ।

জনাব কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ মীমাংসার জন্য এই আইনের সংস্কার প্রয়োজন পুনর্নিবেদন করেন এবং সংস্কারের এই উদ্যোগে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় এডভোকেট মোহম্মদ ইব্রাহিম মিয়া আইনটির সীমাবদ্ধতা এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার সাথে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলোও চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে ৯৪ হাজার ৪৪৪ জনের বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা মাত্র একজন এবং একজন বিচারকের বিপরীতে মামলার সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৮৮৩ টি। ফলে আদালতে বিরোধ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে এবং জনগণ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। জনগণ আদালতের পরিবর্তে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে বেশি আগ্রহী এবং আইনটি সংস্কার করলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাথে নারীদের বিশেষভাবে উপকৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব জনাব শাহ মোঃ আবু রায়হান আল-বিরুনী বলেন, ২০০৪ সালে ২৫ হাজার টাকার যে আইন করা হয় সেইটি মূদ্রাস্ফীতিতে হিসাব করলে এই সময়ে এসে খুবই অপ্রতুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন প্রণয়নের যে তেরোটি ধাপ রয়েছে সরকারের স্বদিচ্ছায় তা তিন মাসে অতিক্রম করা সম্ভব।

জনাব নূর মোঃ খান লিটন বলেন, এই সংস্কার প্রস্তাবনায় আপিলের সুযোগ খণ্ডিত না করে অবাধ আপিলের পূর্ণ সুযোগ থাকা প্রয়োজন।

জনাব এস এম সৈকত বলেন, চারটি সিটি কর্পোরেশন নগর যুব কাউন্সিল তৈরি করেছে এবং পৌরসভাগুলিও এই ধরনের কাউন্সিল কাঠামো তৈরি করে আইনি কাঠামোর সাথে সংযুক্তি তৈরি করতে পারে। যেহেতু অপরাধী এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে যুবদের সংখ্যা বাড়ছে সেক্ষেত্রে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বোর্ডে নির্বাচিত যুব কাউন্সিলের প্রতিনিধি সম্পৃক্ত করার সুযোগ থাকতে পারে।

বাংলাদেশ উচ্চ আদালতের সিনিয়র আইনজীবি জনাব জেড আই খান পান্না বলেন, কোন বিচারের বিরুদ্ধে আপিল করার, পূণর্বিবেচনা বা পূণর্বিচার চাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। অবাধ আপিলের সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে।

জনাব হাজী মোঃ আব্দুল গনি বলেন, আমরা দ্রুততমে সময়ে আইনের সংস্কার প্রত্যাশা করছি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিরোধ মীমাংসা করতে বাধ্য হলেও এই আইনের কারণে মীমাংসাগুলো আইনসম্মত হচ্ছে না। আমরা আইনের মধ্যে থেকে এই বিরোধগুলো মীমাংসা করতে চাই।

জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেন, এই আইনটি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে। মন্ত্রনালয় থেকে সকল মেয়র মহোদয় সাথে যোগাযোগের প্রক্রিয়া চলমান আছে। তাদের মতামত এবং অন্যান্য অংশীজনের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে এই আইনটি কীভাবে যুগপোযোগী করা যায় সে বিষয়ে হয়তো আমরা সহবস্থানে আসতে পারবো।

দ্রুততম সময়ে আইনটি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে জনাব জাকিয়া খাতুন বলেন, পৌরসভার অধিকাংশ সাধারণত জনগণ আদালতে যেতে চান না। তারা বিরোধ মীমাংসার জন্য পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলরদের উপর নির্ভর করেন।

সেমিনারের প্রধান অতিথি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী জনাব মোঃ তাজুল ইসলাম বলেন, শীঘ্রই আইনটি যুগোপযোগী করা হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি ‘বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন, ২০০৪’-এর আর্থিক এখতিয়ার ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। তিনি আরও বলেন, বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে পৌরসভায় এর নাম কী হবে এটি নিয়েও আমাদের পর্যায়ে অনেক আলোচনা হবে। আশা করি, এসব আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটি সমাধানে আসবো।

আলোচনার শেষে ড দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনার কথা আমরা বলি তার অন্যতম হলো নাগরিকদের আইনের শাসন এবং বিচার পাওয়ার অধিকার। এই অধিকার শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক সুপ্রিম কোর্টে নয় বরং মানুষের জীবনকে সহজ করতে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন ২০০৪ সংস্কার মানুষের জীবনকে সহজ করতে অবদান রাখবে।

২৩ এপ্রিল ২০২৪ তারিখ, মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন (এমএলএএ), মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ম্যাব) ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন-এঁর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা), বোর্ড আইন, ২০০৪ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা হতে গত ৬ মে ২০২৪ তারিখ এই ক্রোড়পত্রটি  সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।