২০২২-২৩ অর্থবছর যে ৬ টি চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী শুরু করেছিলেন, তার বর্তমান পরিস্থিতি এখন বেশ গুরুতর। তবে দেরিতে হলেও সরকার অর্থনীতির ব্যর্থতাগুলো স্বীকার করে যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে সেটি ইতিবাচক। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় একটি অন্তর্বর্তীকালীন উত্তরণ সমঝোতা নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অর্থনীতির বর্তমান চাপ থেকে উত্তরণ করতে জাতীয়ভাবে অংশ্রগ্রহণমূলক ও পরামর্শমূলক একটি নীতি সমঝোতার সুপারিশ করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে ১১ আগস্ট ২০২২ তারিখে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)’এর সম্মাননীয় ফেলো এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ- এর আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে “বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার লক্ষ্যে একটি উত্তরণকালীন নীতি সমঝোতা” শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল আলাপচারিতায় যুক্ত হন। তিনি মূলত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পূর্ব ও পরবর্তী বিশ্লেষণের তিনটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন। বাজেট উত্থাপনে চিহ্নিত ৬ টি চ্যালেঞ্জের বর্তমান অবস্থা, অন্তর্বর্তীকালীন অর্থনৈতিক নীতি সমঝোতা ও এর উদ্দেশ্য এবং চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সার্বিক মতামত।
তিনি বলেন, বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী ৬টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। প্রথমত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কিন্তু বাজেট পরবর্তী দুই মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, ভর্তুকির জন্য বাড়তি অর্থ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছিল এবং ২০২৩ সালের জন্য ভর্তুকি ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক সহায়তার ব্যবহার বাড়ানো ও অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা। এক্ষেত্রে যদিও বৈদেশিক সহায়তার ব্যবহার বাড়েনি। অপরদিকে ৮টি মেগা প্রকল্পের কাজ ৫০ শতাংশও হয়নি, যেগুলো ২০২৪ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। চতুর্থ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা, কিন্তু এ খাতে বরাদ্দ ও ব্যয় দুটি কম। দেশের সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামোতে জোর দেওয়া হচ্ছে। ২০টি মেগা প্রকল্পে ব্যয় করা হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রা বিনিময়ের হারের চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ২ মাসে রিজার্ভ ৫.৫ শতাংশ কমেছে। যদিও, পূর্বের তুলনায় প্রত্যক্ষ কর আহরণ বৃদ্ধি চলমান পরিস্থিতির একমাত্র ইতিবাচক পরিবর্তন।
অর্থাৎ বাজেট ঘোষণার পর গত ২ মাসে ৬টি চ্যালেঞ্জের ৫টি আরও বড় আকার ধারণ করেছে। প্রতিবছরই বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় ৬০ শতাংশ বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে হয় উল্টো। বছর শেষে ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে সরকার যে ঋণ নেয়, তা বেসরকারি খাতের চেয়ে বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট-পরবর্তী বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, অর্থনীতির অতিমারি উত্তর পুনরুজ্জীবন এখনো সম্ভব হয়নি। সামষ্টিক অর্থনীতি একটি চাপে রয়েছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিও তেমন ভালো অবস্থানে নেই। মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ, ভর্তুকির জন্য বাড়তি অর্থায়ন, বৈদেশিক অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন, দৃশ্যমান উন্নয়নের ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতকে অবহেলা, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের পার্থক্য বৃদ্ধি প্রভৃতি সূচকগুলোরও অবনতি হয়েছে।
চলমান সংকট মোকাবিলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে কোন বিষয় মোকাবিলা করার ক্ষমতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আর্থিক কাঠামো এখনো উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথে সমর্থন দেওয়ার মত নয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, টাকার মান দুর্বল হয়েছে, যেগুলো তিনি মনে করেন রোগের উপসর্গ। আমাদের রাজস্ব আয় এখনো ১০ শতাংশের নিচে। যদি কর-জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশ থাকতো তাহলে বর্তমানে এতো চাপ তৈরি হতো না। এক্ষেত্রে, চলমান পরিস্থিতি সাপেক্ষে সরকারের তিনটি করণীয় আছে বলে তিনি মনে করেন। অংশগ্রহণ মূলক নীতি সমঝোতার জন্য বিরোধী দল, সরকারে রাজনৈতিক সহযোগী, সুশীল সমাজ, অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ সহ বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করে ২-৩ বছরের একটি স্বল্প মেয়াদি কৌশল প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি। এই সমঝোতায় নীতি বিষয়কেই প্রাধান্য দিতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান অব্যাহত রাখা এবং গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার ওপর জোর দেন। নীতি প্রণয়নে ঐকমত্য থাকার কথাও বলেন তিনি। যাতে আগামী দিনে রাজনৈতিক টানাপোড়ন হলেও আর্থিক খাতকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়।
আলোচনায় তিনি আরো বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে দরিদ্র সরকার বিগত দশকে নিজের আর্থিক সংস্থান নিশ্চিত না করায় এর করুণ পরিণতি ভোগ করছে দেশ। সাম্প্রতিককালে অর্থনীতি নিয়ে সকলেই সচেতন। এখনই সময় আগামী অভিক্ষেপ বিবেচনা করে, সমস্ত চিন্তাগুলো একত্রিত করে একটি সামগ্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কেননা অর্থনৈতিক ঝুঁকির কারণ যাই হোক, ২০২৪ সাল শেষ হওয়ার আগে এই দুর্যোগ কাটবে না বলে মত প্রকাশ করেন তিনি। আর্থিক খাতই হলো অর্থনীতির ফুসফুস; যার সাথে জড়িত ব্যাংকিং খাত ও ব্যাংক বহির্ভূত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তিনি উল্লেখ করেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি নয়, আর্থিক খাতের দুর্বলতাই মূল খলনায়ক। আলোচনার শেষে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।