মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর পরই যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশকে পূণর্গঠন করার লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে সম্পদ সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কালভার্ট ইত্যাদি মেরামতের মাধ্যমে দেশকে পূণর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে কিছু স্থানীয় উদ্যোগ। কালক্রমে এই ব্যাক্তি উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয় জনউদ্যোগ। তারই ধারাবহিকতায় যুক্ত হতে থাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন দাতা সংস্থা। বিস্তার লাভ করতে থাকে কাজের পরিধি। বিস্তৃত কাজের সুষ্ঠূ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এই খাতের উদ্যোক্তাগণ নতুন করে কর্মকৌশল নির্ধারণ করেন। দেশব্যাপী তৃণমূল পর্যায়ে সামজিক সংগঠন তৈরীর মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে কাজ শুরু করেন। সেসব সামাজিক সংগঠনই বর্তমানে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও নামে পরিচিত। সময়ের সাথে সাথে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওসমূহ  ত্রাণ ও পূণর্বাসন কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম বিশেষ করে বয়স্কশিক্ষা, সরকারি বিভিন্ন সেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিতকরণ, সরকার কর্তৃক প্রণিত অধিকার ভিত্তিক আইনসমূহ সম্পর্কে তৃণমূলের জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, পয়:নিস্কাশন, পরিবেশ রক্ষা, কৃষি উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, পারিবারিক সম্পর্ক উন্নয়ন, মানবাধিকার রক্ষা, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজে যুক্ত হয়। বেসরকারী এসব উন্নয়ন সংস্থার সার্বিক কার্যক্রমের ফলে এটি একটি সেক্টর হিসাবে স্বীকৃিত লাভ করে। যা আজ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং প্রশংসিত। বলতে গেলে সেদিনের সেই ব্যাক্তি উদ্যোগই আজকের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী উন্নয়ন খাত বা এনজিও সেক্টর। ব্যাক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা আজকের প্রতিষ্ঠিত এই এনজিও খাতে সরাসরি কয়েক লক্ষ শিক্ষিত ছেলে মেয়ে কর্মরত আছে। যা দেশের বেকার সমস্যা সমাধান ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঘরে একজনকে চাকুরী দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণে সহায়তা করছে। এনজিওসমূহের কার্যক্রম মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনে যেমন সহযোগিতা করছে, তেমনি বর্তমানে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এনজিওরা নিরন্তর কাজ করে চলেছে।

সামাজিক ও অধিকার রক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সাবলম্বিতা অর্জণের লক্ষ্যে এনজিওদের একটি বৃহৎ অংশ বর্তমানে  ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থা (Non Banking Financial Institution) হিসেবে কাজ করছে। যারা দরিদ্র মানুষকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে পুজিঁ সরবরাহ করে উদ্যোক্তা হিসাবে তৈরী  করে দারিদ্র বিমোচনে অবদান রাখছে। বিদেশী আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করাও এই ধারার এনজিওসমূহের অন্যতম উদ্দেশ্য। বিশ^ব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের এনজিওসমূহ যার যার অবস্থান থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করেছে এবং সরকারের ঘোষনা অনুযায়ী ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রেখেছে।

ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী এনজিওসমূহ বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন উৎস্য থেকে মুলধন সংগ্রহ করে, দলীয় সদস্য বা উপকারভোগীদের মাঝে পুজিঁ সরবরাহ করে কিস্তিভিত্তিক আদায় করে এবং ঘূর্ণায়নমান পদ্ধতিতে পুণঃরায় পুঁিজ সরবরাহ করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখে। সারাদেশে বর্তমানে সাত শতাধিক বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও সরকারি নিয়ন্ত্রণনাধীন মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটির অনুমতি নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে যার বাৎসরিক টার্নওভার প্রায়  দেড় লক্ষ কোটি টাকা।  চলমান  কোভিড ১৯ বা করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ৩১ মে, ২০২০ পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সীমিত আকারে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার করার অনুমতি প্রদান করলেও স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসন এ বিষয়ে নমনীয় না হওয়ায় কিস্তি আদায় একরকম বন্ধই আছে। বলা প্রয়োজন, উপকারভোগীদের কাছ থেকে কিস্তি আদায় করতে না পারলেও, এনজিওসমুহের পুঁিজ সরবরাহের উৎস প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সুদসহ মূলধনী কিস্তি  আদায় অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটির নির্দেশনা মোতাবেক সদস্যদের সঞ্চয়ও নিয়মিতভাবে ফেরৎ দিতে হচ্ছে। ফলে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী সংগঠনসমূহের মূলধন ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এসব এনজিও আদায়কৃত ঋণের সার্ভিস চার্জ  থেকেই অফিস ভাড়া, কর্মী বেতনসহ যাবতীয় পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। একদিকে ঋণের কিস্তি আদায় করতে না পারা, অন্যদিকে মুলধন সরবরাহের উৎস প্রতিষ্ঠানের সুদসহ মুলধনের অংশ ফেরত এবং সদস্যদের চাহিদা মোতাবেক সঞ্চয় ফেরৎ দেওয়ার কারণে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসমুহের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মূলধন সংকটজনিত কারণে উপকারভোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ প্রদান করতে পারছে না, এ সুযোগে স্থানীয় মহাজনরা আবার মাথচাড়া দিয়ে উঠছে  এবং অর্থনৈতিক কষ্টেপতিত সাধারণ মানুষ মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং যে মহাজনি প্রথার বেড়াজাল ভেংগে এনজিওরা সাধারণ মানুষদের সহজশর্তে অর্থের সংস্থান করছিল তা আবার পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। গ্রামীণ মানুষ আবারও দারিদ্রের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হওয়ার পথে হাটছে। তাই এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনি এনজিওসমূহকে স্বাভাবিক ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদান করা প্রয়োজন। গরীব মানুষের অর্থ যোগানের এ খাতটি বহুবিধ চ্যালেন্জ মোকাবিলা করে একটা সুদৃঢ় ভিত্তির দিকে এগুচ্ছিল। এটি সমস্যায় পড়লে স্বল্প আয়ীদের বিস্বস্ত ও ভরসার জায়গাটি দূর্বল হয়ে যাবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি আবার মহাজনি প্রথার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়বে।

সুনিদিষ্টভাবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যায়:

  • এমআরএ কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্রের কারণে সদস্যদের নিকট হতে ঋণের কিস্তি আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। পক্ষান্তরে মূলধন সরবারহকারী সংস্থাকে নিয়মিত মুলধনের অংশ ফেরত দিতে হচ্ছে।
  • ঋণ আদায় ও বিতরণ কার্যক্রম অনিশ্চিয়তা ও হুমকির সম্মুখীন।
  • সকল ধরণের আয়বর্ধণমুূলক কর্মকান্ড স্থবির এবং কর্মসংস্থান সংকুচিত।
  • উপকারভোগীদের উৎপাদন ও পন্য বাজারজাতকরণ ব্যাহত।
  • অধিকাংশ সদস্যদের ঋণ ফেরতে অনিহা।
  • জীবন জীবিকা রক্ষার্থে উপকারভোগিদের স্থান পরিবর্তণ।
  • গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব।
  • প্রান্তিক পর্যায়ে জীবিকা নির্বাহের ব্যয় বৃদ্ধি।
  • শ্রমিক ও মজুর শ্রেণী কর্মহীন।
  • ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসা বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব।
  • কৃষি, মৎস্য ও প্রণিসম্পদ খাতে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে ধ্বস;
  • ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরূপ মনোভাব।
  • স্থানীয় গনমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে ও নেতিবাচক প্রচারনা।