Budget Recommendations

করোনা অতিমারি জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতির সৃষ্টি করেছে। সমগ্র বিশ্ব যখন এই ক্ষত কাটিয়ে উঠছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশও সেই অনিশ্চয়তার ফল ভোগ করছে। বিশেষত, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙ্গে পড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় পিছিয়ে পড়া মানুষ নতুন করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ ১৭ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে “আসন্ন বাজেট নিয়ে জনমানুষের প্রত্যাশা” শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপের আয়োজন করে। উক্ত সংলাপে পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা অংশ নেন। আসন্ন বাজেট থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা কী এবং তারা কোন্‌ ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন – সেই বিষয়ে আলোচনা হয়।

সংলাপের আলোচকবৃন্দ এই বিষয়ে একমত যে, আসন্ন বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা থাকা জরুরি। এছাড়াও, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান খাতে অতিমারির ফলে কী কী ক্ষতি হয়েছে এবং কিভাবে সেটা পুষিয়ে নেওয়া যায়, সেই বিষয়েও আলোচনা হয়। উদ্ভূত সমস্যাগুলো নিরসনে ব্যাপক আকারে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে আলোচকরা মনে করেন। সেই সাথে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আরও সুষ্ঠুভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসা উচিত বলেও তারা দাবি জানান।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, বাজেটে জনসাধারণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা উচিত। তাই বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পূর্বেই জনসাধারণের জন্যে একটি খসড়া নীতিমালা উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত যেন জনগণ সরাসরি তাদের প্রত্যাশাগুলো ব্যক্ত করতে পারেন। অর্থনীতির চাকা সচল করতে তাই একটি সম্প্রসারণমূলক মুদ্রা নীতি প্রণয়ন অতীব জরুরি। তাছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করে জনগণকে, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে, সরাসরি বিভিন্ন প্রণোদনা, যেমন – অর্থনৈতিক সুরক্ষা, খাদ্য প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আর এজন্যে পূর্বের সকল প্রণোদনা কর্মসূচির পরিবীক্ষণ প্রয়োজন।

জনাব টনি মাইকেল গোমেজ, পরিচালক, টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম, এডভোকেসি ও যোগাযোগ, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, বলেন, অতিমারির জন্য শিশুদের পড়াশোনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরকেন্দ্রিক বিদ্যালয়গুলো চালু থাকলেও, গ্রামাঞ্চলে বা দুর্গম জায়গাগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। একই কারণে বিগত দুই বছরে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ দু’টোই বেড়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিভিন্ন কারণে যারা ঝরে পরেছে, তাদের স্কুলে ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই এই সমস্যাগুলোর নিরসনে শিশু বাজেট নতুন আঙ্গিকে প্রণয়ন করা দরকার বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, বাজেট প্রণয়নে শিশুদের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত।

 জনাব খন্দকার জহুরুল আলম, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর সার্ভিসেস এন্ড ইনফরমেশন অন ডিজেবিলিটি (সিএসআইডি), বলেন, প্রতিবন্ধিদের বাজেট বলতে শুধুমাত্র সমাজকল্যা মন্ত্রণালয়য়ের বাজেটকে বুঝায়। অন্যদিকে প্রতিবন্ধি মানুষদের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় মাসিক মাত্র ৭৫০ টাকা ভাতা দেওয়া হয়, যা দৈনিক হিসাবে ২৫ টাকা। এটা সহজেই অনুমেয়, ভাতার পরিমাণ বাড়ানো উচিত। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি যে, প্রতিবছর ভাতাপ্রাপ্যদের সংখ্যা বাড়লেও, ভাতার পরিমাণ বাড়ে না। আসন্ন বাজেটে তাই প্রতিবন্ধি মানুষদের সুরক্ষা বেষ্টনী টাকার অঙ্কে বাড়াতে প্রস্তাব করেন তিনি।

আসন্ন বাজেট থেকে ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীর প্রত্যাশার কথা উল্লেখ করে ড. রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বলেন, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ট্রান্সজেন্ডারের সংজ্ঞায়ন সুস্পষ্ট নয়। এমনকি ট্রান্সজেন্ডারদের ওপর অতীতে কখনোই কোন শুমারি পরিচালনা করা হয়নি। ফলে, তাদের দাবি ও চাওয়া-পাওয়া এক অর্থে হিসাবে বাইরে চলে যায়। এই বিষয়ে তিনি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করেন। যেমন – ট্রান্সজেন্ডারদের স্বল্প সুদে ব্যবসায়িক ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা, তাদেরকে কর্মসংস্থানে যুক্ত করার লক্ষ্যে নিয়োগদাতাদের সুনির্দিষ্ট প্রণোদনা প্রদান, ট্রান্সজেন্ডারদের স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন নিশ্চিত করতে তাদের পরিবারদের প্রণোদনা প্রদান করার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

জনাব শাকিব নবী, কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ, কর্ডএইড, বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক বর্তমানে অনানুষ্ঠানিকভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, তারা সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষি খাতের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি আরও মনে করেন যে, পরিস্থিতির উন্নয়নে সামগ্রিক কৃষি কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। জনাব মো. মোস্তফা আলী, সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ, এই বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেন যে, কৃষি নিয়ে সরকারের আরও পরিকল্পিত নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, অঞ্চলভেদে প্রয়োজনীয় কৃষি কর্মকর্তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই এসব সমাধান করতে কৃষি সংক্রান্ত সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লামিয়া আক্তার মীম, শিক্ষার্থী, উচ্চমাধ্যমিক (২য় বর্ষ), মনে করেন, স্থানীয় সরকার কাঠামোকে আরও শিশুবান্ধব করতে হবে। এই লক্ষ্যে আসন্ন বাজেটে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও সিটি কর্পোরেশন পর্যায়ে মোট বাজেটের ১০ শতাংশ শিশুদের জন্যে বরাদ্দ রাখতে হবে। এছাড়াও এই এলাকাগুলোতে শিশুদের তথ্য হালনাগাদের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এমনকি জবাবদিহিতার ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটের সকল তথ্য উন্মুক্ত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় দরিদ্র শিশুদের জন্য ভাতা বাধ্যতামূলক থাকবে বলে তিনি আশা করেন। বাংলায় স্নাতক(সম্মান) সম্পন্নকারী জনাব বিপ্লব চন্দ্র দাস, বলেন, দলিতদের জন্যে খাসজমি নির্ধারণ করে আবাসন বরাদ্দ নিশ্চিত করা উচিত। এছাড়াও, আসন্ন বাজেটের মাধ্যমে দলিতদের শিক্ষাগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্যে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা উচিত।

অতিমারির ফলে স্কুল শিক্ষকরা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে জনাব সাধন কুমার সরকার, প্রধান শিক্ষক, বোগাজান আদর্শ শিক্ষালয় থেকে বলেন, বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা সমাজে অবহেলিত। বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও উদ্ভূত পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে আসন্ন বাজেটে তাদের চাকরি জাতীয়করণের জন্যে আলাদা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেন তিনি। জনাব খোকন সুইটেন মুরমু, ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, কাপেং ফাউন্ডেশন, বলেন, অতিমারির ধকলে সমতলের আদিবাসীদের ঋণের বোঝা বেড়েছে। অন্যদিকে, জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের জন্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখযোগ্য কোন বরাদ্দ থাকে না। তাই এই ভঙ্গুর দশা থেকে উত্তোরণের জন্যে বাজেটে আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি অনুচ্ছেদ রাখার প্রস্তাব করেন তিনি। বিগত সময়ের প্রণোদনা প্যাকেজের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সব ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজগুলোতে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

পরিবহণ শ্রমিকদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টার ওপর আলোকপাত করে জনাব আহসান হাবীব বুলবুল, সাধারণ সম্পাদক, সোশ্যালিস্ট লেবার ফ্রন্ট, বলেন, পেশাগত কারণে দীর্ঘসময় কাজে নিয়োজিত থাকায় পরিবহণশ্রমিকদের খুব অল্প বয়সেই কর্মক্ষমতা হারাতে হয়। তাছাড়া নানাধরনের রোগ-ব্যাধিতেও তাদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। এজন্যে তিনি প্রস্তাব করেন যে, আসন্ন বাজেটে শ্রমিকদের জন্যে ভর্তুকি মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য কার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও, পরিবহণশ্রমিকদের দুর্ঘটনা বীমার আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

সীমা মোসলেম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সব নারীই একধরনের প্রান্তিক অবস্থানে বিরাজ করে। অতিমারিকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক নারী উদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটেছে। অন্যদিকে, তৈরি পোশাকশিল্পে সাম্প্রতিককালে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ক্রমহ্রাসমান, যার মূল কারণ হচ্ছে উৎপাদনব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির আবির্ভাব। তাই নিত্য নতুন প্রযুক্তির আগমনের সাথে তাল মিলিয়ে বিদ্যমান নারী কর্মীদের দক্ষ করে তুলতে বাজেটে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও অভিবাসী নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানোর পরিবর্তে আরও দক্ষ কর্মী হিসেবে পাঠানো যায় কিনা সেটার পরিকল্পনাও আসন্ন বাজেটে থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

জনাব অভ্র ভট্টাচার্য যুগ্ম পরিচালক, সংলাপ ও প্রচার, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), তার সূচনা বক্তব্যের শুরুতেই অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে বর্তমান বাজেট বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, দুই বছর আগে উদ্ভূত অতিমারির অভিঘাত এখনও বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন গবেষণায় এটি প্রমাণিত যে, অতিমারির প্রভাব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ওপর সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া, বৈশ্বিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ও দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি – এই সকল চ্যালেঞ্জ নিয়ে আগামী বাজেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সামিয়া আফরীন, প্রজেক্ট পরিচালক, নারীপক্ষ; জনাব আরিফ চৌধুরি, সভাপতি, জাতীয় হকার ফেডারেশন; জনাব আবদুল আজিজ, কৃষক, পটুয়াখালি এবং শারমিন সুলতানা শম্পা, খামার ব্যবসা সংক্রান্ত উপদেষ্টা, গাইবান্ধা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের সুপারিশগুলো তুলে ধরেন। এছাড়াও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।