অতিমারির ফলে গতবছরের মার্চ মাস থেকে প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি বিবেচনা করে গত সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সীমিত আকারে স্কুলগুলো খোলা হয়েছে। কিন্ত স্কুল খোলার পর দেখা যাচ্ছে ‘ঝরে পড়া’ শিশুর সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক গবেষণা ও জরিপ অনুযায়ী এই সমস্যার মূল কারণ বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম। এটি অনস্বীকার্য যে, করোনা কালে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিশু মূলত দরিদ্রতা এবং অন্যান্য সামাজিক কারণে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমের শিকার হয়েছে যা প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকতর তীব্র।
এই প্রেক্ষিতে ২৫ অক্টোবর ২০২১ তারিখে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)-এর পক্ষ থেকে “অতিমারি-উত্তর শিশুদের স্কুলে ফেরা” শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রেখে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো বলেন, প্রায় ১০-১২% মেয়ে শিশুরা বাল্যবিবাহের শিকার। এটি যতটা না অর্থনৈতিক, তার থেকেও অনেক বেশি সামাজিক সংকট। অভিঘাতের ফলে শিশুদের পরিবারে বিভিন্ন ধরণের ব্যয়ের ক্ষেত্রে সঙ্কোচন হয়েছে। দেখা গিয়েছে তারা কখনো আমিষের পরিমাণ কমিয়েছেন, কখনো খাবারের পদের পরিমাণ কমিয়েছেন, আবার কখনো একবেলা খাবারও কমিয়েছেন। তবে আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ১৫-২০ শতাংশ পরিবারে শিশু খাদ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয় সঙ্কোচন করতে হয়েছে যা শিশুদের পুষ্টিহীনতা অনেকাংশে বাড়িয়েছে।
সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর কোর গ্রুপ সদস্য। তিনি বলেন অতিমারির কারণে শিশু শ্রম ও অল্প পয়সায় শিশুশ্রমিক নিয়োগ বেড়ে গিয়েছে। ৯ম ও ১০ম শ্রেণির মেয়েরা স্কুলে ফিরছেনা কারন তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। লকডাউনকালীন সময়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ২১টি জেলায় জরিপ চালায়। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, দশ (১০) থেকে সতের (১৭) বছর বয়সের প্রায় তের (১৩) হাজার মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে যা বেশ আশংকাজনক। যৌন নির্যাতন ও শারিরিক সহিংসতাও এর মধ্যে বেড়েছে। এক্ষেত্রে শাহীন আনাম, সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং সচেতনতা বাড়ানোর সুপারিশ করেন। পাশাপাশি সাহায্যের জন্য হেল্পলাইন নাম্বার বাড়ানো এবং এই সংকটকালীন সময়ে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ রোধে জাতীয় ক্যাম্পেইন এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছেও বলে তিনি মনে করেন।
সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেন সৈয়দা মুনিরা সুলতানা, ন্যাশনাল প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর, আইএলও। গত ২ বছরে শিশু শ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৈশ্বিকভাবে এই সংখ্যা ৮৬ মিলিয়নেও পৌঁছাতে পারে বলে তিনি মনে করেন। ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, যুগ্ম মহাপরিদর্শক, স্বাস্থ্য শাখা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বলেন, এসডিজি কে লক্ষ করে শিশুশ্রম নিরসনের জন্য একটি একশন প্ল্যান তৈরি হচ্ছে। তানজুমা পারভীন লুনা, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, কুমিল্লা বলেন, মাঠ পর্যায়ে এ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। সামাজিক জাগরনের চেষ্টা করতে হবে সরকারি, বেসরকারি ও সম্মিলিতভাবে।
সংলাপে সম্মানিত আলোচক হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন নাজমা শেখ, উপ-সচিব (বিদ্যালয়), প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়; জনাব মো. বেলাল হোসাইন, পরিচালক (মাধ্যমিক), মাধ্যমিক উইং, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর; ড. শফিকুল ইসলাম, সাবেক পরিচালক, শিক্ষা কর্মসূচি, ব্র্যাক; ড. মোহাম্মদ নান্নু মোল্লা, যুগ্ম সচিব, শ্রম অধিশাখা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; জনাব আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত, উপ-মহাপরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম ও জনাব শাহীন ইসলাম, প্রকল্প পরিচালক, সেভ দ্য চিলড্রেন, বাংলাদেশ। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে বক্তব্য রাখেন জেসমিন নাহার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, নীলফামারী; ফেরদৌসি নাজনিন, উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার, কুমারখালী, কুষ্টিয়া; জনাব স্বপন কুমার দত্ত, উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ; রওশন আরা বেগম, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, বরিশাল ও উম্মে নেহার, নির্বাহী পরিচালক, উদ্যোগ।
সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মোট ১৫টি সামাজিক সেক্টর নির্ভর মন্ত্রনালয় আছে যাদের বাজেটের শতকরা ২০ ভাগ শিশুদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। এই বাজেট কিভাবে করা হচ্ছে এবং এর বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তার সঠিক ফলোয়াপ করলে সমস্যা অনেকটা নিরসন করা সম্ভব।
সরকারের প্রস্তুতি এবং পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার বাস্তবায়নের যায়গায় সমন্বয়ে জোর দিতে হবে বলে প্রস্তাব করেন গণসাক্ষরতা অভিযান-এর নির্বাহী পরিচালক এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি মিডিয়ের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন, বিয়ে হয়ে যাওয়া শিশুরা উপবৃত্তি পাচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ে সামগ্রিকভাবে যাতে সকল শিশু উপবৃত্তি পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সংলাপ সঞ্চালনা করেন সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে এই প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত সংস্থার প্রতিনিধি ও ব্যাক্তিবর্গ এবং জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এই সংলাপে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত ও মন্তব্য তুলে ধরেন। এছাড়াও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।