জাতীয় উন্নয়ন কতখানি সুষমভাবে স্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বোঝার জন্য নাগরিক প্ল্যাটফর্ম সম্প্রতি উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে সাতটি নাগরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করে। এই পরামর্শ সভাগুলি অনুষ্ঠিত হয় রংপুর (৪ জুন ২০২২), খুলনা (২ জুলাই ২০২২), টাঙ্গাইল (৩১ জুলাই ২০২২), সিলেট (১৩ আগস্ট ২০২২), ঠাকুরগাঁও (২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২), রাঙ্গামাটি (১ অক্টোবর ২০২২) এবং চট্টগ্রামে (২ অক্টোবর ২০২২)। বাংলাদেশের ২৫টি জেলার ৫০০ এরও অধিক নাগরিক এই সভায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁদের মতামত ও পরামর্শ ব্যক্ত করেন। এছাড়া প্রতিটি স্থানে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে পৃথক আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সাথেও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয় পর্যায়ে প্রাপ্ত এসব মতামত জাতীয়ভাবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে নাগরিক নাগরিক প্ল্যাটফর্ম একটি মিডিয়া ব্রিফিং- এর আয়োজন করে যা ১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ, ব্র্যাক সেন্টার ইন, মহাখালী, ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন অর্জনের একটি অনুকরণীয় উদাহরণ– এমন একটি দেশ যেটি ৫০ বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে তার সম্ভাবনা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংশয়গুলোকে অতিক্রম করেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতি বছর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, আয়বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং কাঠমোগত বিভিন্ন পরিবর্তনের সমীক্ষা আমাদের সামনে বিদ্যমান। এছাড়াও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, ডিজিটাল সংযোগের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এমনকি কোভিড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ৭৫.২% জনগোষ্ঠীর সকল ডোজের টিকাদান সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে—স্থানীয় বাস্তবতার চিত্র নীতির প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। এছাড়াও বাস্তব সমীক্ষা এবং পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে, যার জন্য এসডিজির স্থানীয়করণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নাগরিক পরামর্শ সভাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় পরামর্শের ভিত্তিতে একটি বিভাজিত স্তরে উন্নয়ন আখ্যানের বাস্তবতা যাচাই করা এবং এলডিসি উত্তরণকালে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলোকে চিহ্নিত করা।
এ প্রেস ব্রিফিং এর সভাপতিত্ব করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এর কোর গ্রুপ সদস্য এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-র সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ব্রিফিং এর শুরুতে বলেন নাগরিক প্ল্যাটফর্ম স্থানীয় নাগরিক সভাগুলো থেকে মূলত স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নের আখ্যান বোঝার চেষ্টা করা করেছে যেখানে নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক- এই তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ ব্রিফিং-এ উপ-আঞ্চলিক পরামর্শ সভার একটি সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। তিনি তাঁর উপস্থাপনায় বলেন—বাংলাদেশ ক্রমাগত ভাবেই উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই জাতীয় উন্নয়ন আলেখ্যের স্থানীয় ভিত্তিটা কতখানি মজবুত? বিশেষ করে যারা প্রথাগতভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ আছে তাদের ভূমিকা কতখানি? তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিনিধিদের সমস্যা অনুধাবনের মাধ্যমে তথ্য উন্মোচন করার লক্ষ্যে সাতটি অঞ্চলে নাগরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয় যেখান থেকে উঠে আসা তথ্যগুলো জাতীয় উন্নয়নকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করেন তিনি।
যদিও বাংলাদেশে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হচ্ছে, আয় বাড়ছে কিন্তু তার মধ্যে অসমতা বিদ্যমান এবং সকল মানুষের কাছে এ উন্নয়নের ধারা সমানভাবে যাচ্ছে না। তিনি তার উপস্থাপনায় উপ-আঞ্চলিক নাগরিক পরামর্শ সভা থেকে উঠে আসা মোট ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করেন। প্রথমত, তিনি বলেন- যুবসমাজের ক্ষেত্রে মানসম্মত কর্মসংস্থানের অভাবের কথা। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিও পিছিয়ে পড়া মানুষের জনজীবনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টিকে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, নারীদের অবদান সমাজে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও তাদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ হচ্ছেনা। অন্যদিকে পরিবেশ দূষণের এর বিষয়টিকেও ড. দেবপ্রিয় জাতীয় সমস্যা বলে মন করেছেন। পঞ্চমত, তিনি যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করেন তা হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি সেবার যথাপোযুক্ত মানের অভাবের বিষয়টি। সর্বশেষ তিনি বলেন যে, বর্তমানে সমাজে একটি ভয়ের সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে মানুষ তাদের বাক-স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের কথা বলা থেকে সংযত থাকছে।
ড. দেবপ্রিয় তাঁর উপস্থাপনায় খাতওয়ারি আলোচনা তুলে ধরেন যেখানে তিনি পাঁচটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা বেড়েছে কিন্তু শিক্ষার গুণগত মানের পতন হচ্ছে। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে অনেকেই আর্থিক সঙ্গতির অভাবে শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ছে। যে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে তা দিয়ে সমগ্র শিক্ষার খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছেনা। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে মানের উন্নয়ন হচ্ছে না। যদিও বড় বড় স্বাস্থ্য
কমপ্লেক্স হচ্ছে, হাসপাতাল হচ্ছে কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে না। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় সুপেয় পানির অভাব এবং পয়ঃনিষ্কাশন এর জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে যা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। এছাড়াও সামাজিক সুরক্ষার পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। এছাড়াও রয়েচে সড়ক নিরাপত্তার অভাবের কথা। সঠিক পরিবহন ব্যবস্থার অভাবের ফলে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ও ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় পর্যায়ে নারী, যুব এবং প্রবীণরা নানারকম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সামাজিক এবং পারিবারিক মণ্ডলে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে যুবরা সমাজ থেকে বিযুক্ত হচ্ছে যার প্রধান কারণ কর্মসংস্থানের অভাব হলেও এর পাশাপাশি আছে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভ্রান্তি, মাদকাসক্তি, মানসিক বিষণ্ণতা, উগ্রবাদের প্রতি আকর্ষণ ইত্যাদি। প্রবীণদের জন্য সুযোগের অভাবের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ব্যক্তিখাতে তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। এছাড়াও নীতি নির্ধারণে তাদের প্রতি মনোযোগের অভাব রয়েছে। স্থানীয় পর্যায় থেকে শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধীদের কথাও উঠে এসেছে যারা সমাজে এমনকি পরিবারেও নিগৃহীত হয়। সবশেষে তিনি হিজড়া জনগোষ্ঠীর কথা বলেন, যাদের প্রতি ঘৃণামূলক আচরণের কথা স্থানীয় আলোচনায় উঠে এসেছে। সর্বোপরি প্রবীণদের প্রতি সহমর্মিতার অভাবের কথা নাগরিক পরামর্শ সভাগুলোতে উঠে এসেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
স্থানীয় পর্যায় থেকে কর্মক্ষেত্রে বিষয়ে তিনটি পেশাজীবিদের কথা এসেছে বলে মন্তব্য করেন ড. দেবপ্রিয়। তিনি প্রথমে বলেন কৃষকদের কৃষকদের অর্থনৈতিক ক্ষতি, সীমাবদ্ধ ব্যাংক ঋণ, বীজ ও পণ্যের বাজারে প্রবেশাধিকারে প্রতিবন্ধকতার কথা।
স্থানীয় পর্যায়ে আদিবাসীরা তাদের ভূমির সমস্যার কথা বলেছেন যা ড. দেবপ্রিয় তার উপস্থাপনায় তুলে আনেন। এছাড়াও দলিত সম্প্রদায়ের বিশেষ করে যারা পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছে তাদের কষ্টের কথাও উপস্থাপনায় উঠে আসে। চাকরিক্ষেত্রে তাদের জন্য কোটা থাকা স্বত্বেও তারা চাকরি পাচ্ছেনা। অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার মাসগুলোতে জেলেদের চাল বরাদ্দের অপ্রতুলতা, চা শ্রমিকদের মজুরি ও জীবিকার সমস্যা এবং অভ্যন্তরীন ও বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগে সমস্যার কথাও উপস্থাপনায় উঠে আসে।
তিনি তার উপস্থাপনার শেষ পর্যায়ে উল্লেখ করেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে যার ফলে নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দ্বন্দের সৃষ্টি হচ্ছে। এক সময় মধ্যবিত্তরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মী ছিলেন কিন্ত আজ তারা নিজেরাও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, আজকে তৃণমূলের বক্তব্য উপস্থাপন হয়েছে যেখানে দুইটি বিষয় উঠে এসেছে তা হলো বণ্টনের দিক এবং আকাঙ্ক্ষার দিক। উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে গড়ের সমীকরণ আমাদের সমাজে আছে সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এই গড়ের কাছাকাছি স্থানীয় মানুষদের তখনই আনা সম্ভব যদি ইতিবাচক বৈষম্যমূলক আলোচনা হয় এবং তা হতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। আর আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, দৃশ্যমান যে উন্নয়ন হয়েছে সেখানের দৃশ্যের সাথে মানের ব্যাপারেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ জায়গাগুলো অর্জন এর জন্য তিনি সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নতুন সক্ষমতা তৈরির কথা বলেছেন। সবশেষে তিনি বলেন যে, তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
Leave A Comment