বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিক্রিয়ায় দেশের নাগরিক সমাজ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। নাগরিক সমাজ মনে করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে রাষ্ট্রের আরো কার্যকরি ভূমিকা রাখা উচিৎ ছিল। গত ২১ অক্টোবর ২০২১ তারিখে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহ ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিবাদ’ শীর্ষক একটি সভার আহ্বান করে যেখানে এ মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। এই সভা থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে দেশের আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি বিধান করার দাবী জানানো হয়। এই সভায় নাগরিক প্ল্যাটফর্মের নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সমাজের গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গ, এবং আক্রান্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সরাসরি উপস্থিত থেকে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সভাটি সঞ্চালনা করেন এবং প্রারম্ভিক বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন সম্প্রতি আমরা সেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন করলাম। দুর্গাপূজার সময়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির এই আক্রমণ যেন স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধের প্রতি আঘাত। ১৯৭৫ পরবর্তীকালে সংবিধানে যে মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে এবং সংকীর্ণ ও স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় অপশক্তির সঙ্গে যে আপস হয়েছে, তার জের ধরেই এই হামলা হয়েছে। এই হামলার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে বিচারহীনতা বলে তিনি মন্তব্য করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে সাম্প্রদায়িক হামলার তদন্তে বর্তমান সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। সেই কমিশন প্রতিবেদন দাখিল করলেও তার সুপারিশের ভিত্তিতে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এরপর রামু ও নাসিরনগরেও হামলা হয়, কিন্তু হামলাকারীদের বিচার হয়নি। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি এই পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এবার কুমিল্লার ঘটনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীনভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা দেখলাম প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাসময়ে পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম না হওয়া ও অনভিজ্ঞতার কারণে এই সহিংসতা বন্ধ করা গেল না।

বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও শিক্ষাবিদ ডঃ হামিদা হোসেন অনুষ্ঠানটির সভাপতি হিসেবে বলেন, গত কয়েক দিন ধরে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলা নির্যাতন চলছে, তাতে সামাজিক নিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে। দেশের সংবিধানও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এতে আমরা অত্যন্ত অবাক হয়েছি। ১৩ অক্টোবর প্রথম হামলা হলো কুমিল্লায়। তখন আমরা আশা করেছিলাম, দেশের পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন তৎপর হবে। বরং আমরা দেখলাম, এই হামলার রেশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কী করা উচিত ছিল আর তারা কী করল, নাগরিক সমাজের এখন কী করা উচিত সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

প্রথম দিন থেকে আমরা কী করলাম, সেই প্রসঙ্গ তোলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ-এর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জনাব কাজল দেবনাথ। দুর্গাপূজার সময় প্রতি বছর সরকারের প্রতিটি সংগঠনের সঙ্গে পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের আলোচনা হয়-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি, র‌্যাবের ডিজি, প্রশাসন সহ সবার সাথে। ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার ঘটনার পরই সেখানকার প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়, তারা আশ্বস্ত করেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে দেখা গেল, ঘটনার জের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকেশ্বরী ও সিদ্ধেশ্বরী এর মতো বড় বড় মন্দির ছাড়া আর কোথাও স্থায়ীভাবে পুলিশ ছিল না। আনসার একজনও ছিল না। কাজল দেবনাথের আক্ষেপ, দেশে তো আরও রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সংগঠন আছে যারা ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু এবার একটা গুণগত ব্যতিক্রম দেখা গেল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এবার কাউকে পাশে পাওয়া গেল না।

ধ্রুবতারা যুব উন্নয়ন ফাউন্ডেশন-এর সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাহী পরিচালক জনাব অর্ক চক্রবর্তী সংক্ষুধ্ব চিত্তে বলেন, অষ্টমীর দিনেও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হামলা হয়। নবমীর দিন সকাল বেলা তিনি ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী অফিসার)-এর কাছে যান। ইউএনও বলেন, সমস্যা নেই, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে পুলিশ থাকবে, অথচ তখনই উপজেলায় মিছিল হচ্ছে। এরপর বলা হলো, দশমীর দিন ১২ টার মধ্যে বিসর্জন দিতে হবে। তিনি আরও কিছু সময় চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই সময় দেওয়া হয়নি। শেষমেশ বাদ্য ব্যবহার না করেই প্রতিমা বিসর্জন দিতে বাধ্য করা হয়। এরপর দুপুরে ২ টার পর কয়েক ঘণ্টা জুড়ে বেগমগঞ্জে নারকীয় তান্ডব চালানো হয়েছে। সভ্য মানুষের পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব নয়। তিনি স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি বলে জানান। তিনি বলেন ‘কোনো ঘটনার দোষীকে হয়তো ধরে ফেলা যায়, কিন্তু ঘৃণা নিয়ে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তার কী হবে?’

যারা গ্রামে পূজা করতে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে শাখা খুলে সিঁদুর মুছে ঢাকায় ফিরেছেন,। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষকের এই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন জনাব রোবায়েত ফেরদৌস এবং বলেন, ‘আমরা কী এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?’ এই সহিংসতার ঘটনা দাঙ্গা নয় বলে মত দেন তিনি। কারণ হিসেবে বলেন, ১৯৭১ সালের পর এমন ঘটনা দেখানো যাবে না, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করেছে বা তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। এটি একতরফা সহিংসতা, দাঙ্গা নয়।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ-এর সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জনাব নির্মল রোজারিও বেদনাহত হৃদয়ে বলেন, দেশের ধর্মীয়/জাতিগত সংখ্যালঘুদের হৃদয় ভেঙে গেছে। এটি তারা প্রত্যাশা করেননি। দুর্ভাগ্য, এই ঘটনার রেশ টানার মতো অবস্থা নেই। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে তিনি নিজেও বিপন্ন বোধ করেন।

ঘরে আগুন লেগেছে, যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছিল, সেখান থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছি বলে মন্তব্য করেন সুজন-‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ডঃ বদিউল আলম মজুমদার। অনেক কারণ আছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতা আছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই তারা থাকে। আগে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো একত্র হতো, কিন্তু এখন শুরু হয়েছে দোষারোপের রাজনীতি। তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার আগে দোষারোপ শুরু হয়। এখন শুধু প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে বলে মত দেন বদিউল আলম মজুমদার।

চাকমা রানী এবং মানবাধিকার কর্মী রানী ইয়েন ইয়েন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘প্রায়ই আমাদের বলা হয়, আপনারাও এ দেশের নাগরিক, ভয় পাবেন না’। কিন্তু দেশের সংবিধানে সংখ্যাগুরুদের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সব নাগরিক বাঙালি হিসেবে স্বীকৃত হবে। তাতে আদিবাসীরা সেই জনস্রোতের বাইরে থেকে যায়। তারা এতে নিজেদের নাগরিক হিসেবে মনে করতে পারেন না।

যারা অসাম্প্রদায়িক, তারাই এ দেশে সংখ্যালঘু বলে মন্তব্য করেন প্ল্যাটফর্মের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য খুশী কবির। আবার এই সম্প্রদায়ের মধ্যে একতাও অত শক্তিশালী নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই দেশকে আমরা কেবল বাঙালি মুসলমানের দেশ হিসেবে দেখতে চাই না। বহুমাত্রিক, বহুজাতিক, বহুসাংস্কৃতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই।

দেশের গণতন্ত্র, সংবিধান, মানবাধিকার, আইনের শাসন-এই চার ক্ষেত্রেই চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অ্যাডভোকেট রিজওয়ানা হাসান। তার মতো মানুষেরাও এখন সমাজে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে, যার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আমরা মন খুলে কথা বলতে পারি না। এই সমাজ, দেশ এমন দিকে যাচ্ছে, যাতে ভিন্নমতের জায়গা নেই।

সাবেক সরকারি কর্মকর্তা জনাব আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন এবারে পূজামণ্ডপ গুলোতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না এবং সহিংসতা রোধে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

ডঃ শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) মনে করেন গত কয়েকদিনে আমরা ১৯৭১ সালের একটি ছোট মহড়া দেখতে পেলাম কিন্তু এই যুদ্ধে হেরে যাওয়া যাবে না। সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ করতে হবে শিক্ষা আন্দোলন দিয়ে। ছাত্র, যুব, নারী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সকল কে যুক্ত হতে হবে এই আন্দোলনে।

সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ডঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অপশক্তি শক্তিশালী কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ, যদিও তারাই প্রকৃত সংখ্যালঘু, আমরা দুর্বল কারণ আমরা বিচ্ছিন্ন, যদিও আমরাই প্রকৃত সংখ্যাগুরু। তিনি বলেন এই সংকট শুধুমাত্র একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়। এটি একটি ধারাবাহিক সমস্যা যার মোকাবেলা করতে হবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে।

জনাব সারওয়ার আলী বলেন, বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে দাবি করার সামর্থ্য জাতির আর নেই। দেশে গত কয়েক বছর ধরে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, যার চূড়ান্ত রূপ এবার দেখা গেল। প্রশাসন নিস্ক্রিয়, রাজনৈতিক নেতারা পারস্পরিক দোষারোপে লিপ্ত। সমাজে উগ্রবাদিতার প্রসার ও চর্চা বেড়েছে, মানুষের জীবনাচরণ, পোশাক ও সংস্কৃতিতে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপণ করা হয়েছে। আমরা কেউ তার বাইরে নই।

সিপিডি’র বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ-এর সদস্য পারভীন মাহমুদ সভার প্রতি একাত্মতা জানিয়ে বলেন, সাম্প্রদায়িক এই হামলার ঘটনায় তিনি লজ্জিত ও দুঃখিত। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য জনাব মুশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণের অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে শিক্ষা। দ্বিতীয়ত, এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক সম্প্রদায়ের মেলামেশা। তৃতীয়ত, ইন্টিগ্রেশন বা একীভূতকরণ। তবে আমাদের সমাজে এক ধর্মের সাথে আরেক ধর্মের বৈবাহিক সম্পর্ক নেই। চতুর্থত, বাংলাদেশের প্রতি ভারত সরকারের আচরণ- তিস্তার পানি বণ্টনসহ বিভিন্ন ইস্যু এখনও অমীমাংসিত। পঞ্চমত, সরকারের ভূমিকা। ষষ্ঠত, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও’র ভূমিকা। স্বাধীনতার পর থেকে এনজিওরা দেশের উন্নয়নে নানাভাবে অবদান রাখলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারেনি।

বিশিষ্ট নাট্য ব্যাক্তিত্ব জনাব মামুনুর রশিদ বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার বন্ধু ঠাকুর দাস বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ তো করলাম, তারপরও কি এই দেশে থাকা যাবে?’ এই কথায় মামুনুর রশিদ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ঠাকুর দাস দেশ ত্যাগ করেন। ১৯৭২ সালেও পূজামন্ডপে হামলা হয়েছিল। তিনি বলেন এখন তো ঠাকুর দাসের কথাই সত্যি হচ্ছে। তার আক্ষেপ, সমাজকে গ্রাস করেছে রাজনীতি, সরকার ও একটি অমানবিক রাষ্ট্র। ফলে সংস্কৃতিও গ্রাস হয়েছে। স্থানীয়ভাবে যে নাটক, গান হতো তা গ্রাস করেছে শিল্পকলা একাডেমি। জেলা প্রশাসক ও কাউন্সিলর শিল্পকলা একাডেমি পরিচালনা করে। অন্য কোনো সংগঠনের স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠার অবকাশ নেই। এমনকি ঢাকা শহরেও তার থাবা বিস্তৃত হচ্ছে। হেফাজতের কথায় শিক্ষা গেছে, কুসুমকুমারী দাসের কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে এর মধ্য দিয়ে তো সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা আগে উপলদ্ধি করা হয়নি বলে শুরু করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। প্রশাসনিক নিস্ক্রিয়তার একটি বিহিত হওয়া দরকার। তার জন্য দরকার, জনমত সৃষ্টি। গণমাধ্যমের বড় একটি ভূমিকা আছে সেখানে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রশ্ন, তবে কেন এমন ঘটছে? মনস্তত্ব কী? রাষ্ট্র, আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতি—এই তিনটি মূল উৎস। রাষ্ট্রের কাজ নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া। অথচ আজ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কথা আমরা বলতেই সাহস পাই না, বড়জোর অসাম্প্রদায়িকতা বলি।

সন্ত্রাস দমনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু যা ঘটল পূজার মধ্যে, তা দেশে চলতে পারে না বলে মন্তব্য করেন জনাব কাজী খলীকুজ্জামান। বাস্তবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব আছে, তবে আমরা তা বাদ দিতে চাই। আমরা সম-নাগরিক হতে চাই। সবাইকে সমান নাগরিক হিসেবে দেখতে চাই। একটি ব্যাপার খুব নাড়া দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও কেউ যদি অসহায় বোধ করেন তাহলে টেকসই উন্নয়ন পিছিয়ে যাবে। অসংখ্য মানুষ এখনো অসহায়। প্রধানমন্ত্রীর এত জোরালো ঘোষণার পরও কারা এসব ঘটাচ্ছে বা ঘটতে দিচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এই প্রতিবাদ সভা থেকে কিছু দাবী তুলে ধরা হয়।

১। স্বল্পমেয়াদী-

ক. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে দেশের আইন অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

খ. ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের প্রয়োজনীয় আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং তাদের ঘর-বাড়ি পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে।

গ. ক্ষতিগ্রস্তদের ধর্মীয় উপাসনালয় পুনর্নির্মাণ করতে হবে।

ঘ. স্থানীয় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে শৈথিল্য থাকলে তা খতিয়ে দেখতে হবে ও তার পুনরাবৃত্তি রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।

ঙ. প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সব ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে হবে এবং উসকানি দাতাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

চ. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ধর্মীয় উসকানির জন্য যারা ব্যাবহার করে, তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইনি সংস্কার করতে হবে।

২। মধ্যমেয়াদী

প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে নাগরিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিবাদ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

৩। দীর্ঘমেয়াদী

সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা ও বোধ শক্তিশালী করতে হবে, সামাজিক সম্প্রীতি, সহনশীলতা ও ধর্মান্ধতা বিরোধী ধারণা শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে সহমর্মিতা ভিত্তিক ও সহিষ্ণু সমাজ গঠন করতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।