ছবিটি তুলেছেন জনাব গোলাম রব্বানী, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক প্রান্তজন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজ নাটোরের কৃষি বিভাগের প্রধান প্রফেসর পারভেজ রানা বলেন, “প্রান্তিক কৃষকদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে অনিয়মই কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নের অন্তরায়। কৃষি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত মাঠ পর্যায়ের সরকারি সুযোগ-সুবিধা বিতরণ ভালভাবে তদারকি করা। সেইসাথে প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। তাহলে দেশের কৃষি ও প্রান্তিক কৃষক সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে যাবে।”

“১০ কাঠায় রসুন আর একটু জমিতে গমের আবাদ করেছি। যে সময় যেই আবাদ আসে, সেগুলো চাষবাস করে সংসার চালাই। চাষবাস করতে কত  সমস্যায় যে পড়ি, কেউ একটু আগায় আসে না। সরকারি কোনো কিছু দেয় না, একটু পরামর্শ চেয়েও পাই না।” এভাবেই প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন নাটোর সদর উপজেলার চন্দ্রকলা এলাকার সাঁওতাল পল্লীর বাসিন্দা কৃষক, আপন উড়াও 

আদিবাসী আপন উড়াও জানান, পরিবারে দুই কন্যা সন্তান রয়েছে তার। তাদের লেখাপড়া খরচসহ বর্তমানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এই বাজারে কৃষি কাজ করে সংসার আর চলছেই না তার।  “ছোটবেলা থেকে আমি বাপ-মায়ের সাথে মাঠে কাজ করি। নিজের জমিজমা নাই, তাই বর্গা নিয়় চাষবাস করি‌। অনেকেই শুনি সরকার থেকে সার, ওষুধ, বীজ পায়। আমি কোনদিনই এসব পাইনি।” আরো বলেন তিনি। 

শুধু আপন নয়, নাটোরসহ সারাদেশেই প্রান্তিক কৃষকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কৃষিখাতের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র জবাবদিহিতার অভাবে দিনের পর দিন বঞ্চিত থাকছেন এসব কৃষকরা। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, কৃষিখাতে নানা ভর্তুকি, প্রণোদনা, বরাদ্দ ও প্রকল্পে খরচ করা হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। তবে সেই টাকার সুফল প্রান্তিক চাষিরা পাচ্ছেন কিনা-তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। প্রান্তিক চাষিদের অভিযোগ, তদারকি ও জবাবদিহিতা না থাকায় অনেক সময় প্রকৃত কৃষকরা সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পদে পদে হয়রানির মুখেও পড়ছেন তাঁরা। অনেক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের পছন্দের লোক, রাজনৈতিক নেতা কিংবা তার স্বজনপরিচিতরাপ্রণোদনার টাকা বা সামগ্রী যথাযথ বণ্টন না করে নানারকম দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে মাঠ পর্যায়ের একটি চক্রের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে আছেন প্রান্তিক ক্ষুদ্র চাষিরা 

এবার কথা হয় জেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলী খাঁ এর সঙ্গে। মোহাম্মদ আলী খাঁ প্রান্তিক কৃষকদের ভেতর তুলনামূলক বড় কৃষক। তিনি ভুট্টা, পেঁপে, বেগুন, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফল ফসলের চাষ করে থাকেন। মাঠ পর্যায়ে যে কৃষকরা একটি চক্রের দ্বারা বন্দি হয়ে আছেন, বিষয়টির প্রমাণ মেলে তার সাথে কথা বলে। তিনি বলেন, “এই এলাকায় উৎপাদন হয় এমন বেশিরভাগ ফল-ফসল আমি চাষ করি। কিন্তু কৃষকদের জন্য আসা একটি টাকাও কোনো সময় পাইনি। সুপারভাইজার এলাকায় আসে (কৃষি উপ-সহকারী), তার সঙ্গে যাদের ভালো খাতির তাদেরকেই সকল প্রণোদনা দিয়ে চলে যায়। বারবার ওই একই কৃষকরা পায় সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা। আমরা সুপারভাইজারকে ডেকেও জমিতে নিয়ে যেতে পারি না। তিনি আমাদের কথায় কর্ণপাত করেন না। 

পাশের গ্রামের (বাঙ্গাবাড়িয়া) কৃষক জাহাঙ্গীর আলম শীতের দুপুরে তার বেগুন ক্ষেতের পরিচর্যা করছিলেন। কথা বলে জানা যায়, তার সংসারে স্ত্রী, তিন সন্তান ও বিধবা মা রয়েছেনজাহাঙ্গীর একা কৃষিকাজ করে তার পরিবারের ব্যয়ভার বহন করেন। জমি বর্গা নিয়ে ক্ষেতে বেগুন, পেয়াজ ও রসুনের আবাদ করছেন। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পান কিনা জানতে চাইলে বলেন, “আমাদের কি কেউ চেনে যে আমরা পাব? যারা পাওয়ার তারাই প্রতিবার পায়। এলাকার মেম্বারের সঙ্গে যাদের খাতির বেশি, তাদেরই কৃষি অফিসাররা দেখে। এমনকি পরামর্শটুকুও পাই না।” 

এসব বিষয়ে নিয়ে প্রতিবেদক এরপর কথা বলেন কৃষিখাতে বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মাননা এগ্রিকালচারাল ইম্পরট্যান্ট পারসন (এআইপি) পদকপ্রাপ্ত কৃষক সেলিম রেজার সঙ্গে। 

সেলিম রেজা প্রতিবেদককে বলেন, “প্রান্তিক কৃষকরাই আমাদের দেশের মূল চালিকাশক্তি। আমাদের ঘামের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে, আমরা ফসল উৎপাদন করি। অন্য সময়ের চেয়ে বর্তমানে কৃষি অনেক আধুনিক হয়েছে এতে সরকারের ভূমিকাও ব্যাপক। কিন্তু কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের যে সকল সুযোগ-সুবিধা, সেগুলো আদৌ কতটুকু সঠিকভাবে প্রান্তিক কৃষকরা পাচ্ছে তা নিয়ে একটি প্রশ্ন সব সময় থেকেই যায়। এই ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের কিছু জায়গায় যদি সেবাদাতাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়, তাহলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন আনা সম্ভব। তাহলে দেশের প্রকৃত প্রান্তিক কৃষকরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তাদের কৃষি কর্মকাণ্ডকে আরো বৃদ্ধি করার সাহস এবং অনুপ্রেরণা পাবে।‌ ফলে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজ নাটোরের কৃষি বিভাগের প্রধান প্রফেসর পারভেজ রানা বলেন, “কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান কর্মকাণ্ড ও জীবনীশক্তি। উৎপাদনশীলতা-আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্য কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের জিডিপিতে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই কৃষি খাতের মূল ভীত হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকরা। কিন্তু তারাই অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক সময় বঞ্চিত ও অবহেলিত থাকে। 

তিনি আরো বলেন, “প্রান্তিক কৃষকদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে অনিয়মই কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নের অন্তরায়। কৃষি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত মাঠ পর্যায়ের সরকারি সুযোগ-সুবিধা বিতরণ ভালভাবে তদারকি করা। সেইসাথে প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। তাহলে দেশের কৃষি ও প্রান্তিক কৃষক সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে যাবে। 

বিষয়ে নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘জেলার প্রান্তিক কৃষকসহ সামগ্রিক কৃষির উন্নয়নে কৃষি বিভাগ সব সময় কাজ করে যাচ্ছে। এর ভেতরেও অনেক জায়গায় মাঠ পর্যায়ে নানান অনিয়মের কথাও আমাদের কানে আসে। সেগুলোর অনেক সময় সত্যতা পাওয়া যায় না। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কেউ যদি আমাদেরকে জানায়, অবশ্যই মাঠ পর্যায়ের কৃষি অফিসারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। 


এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ‘যুবদের জন্য উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ বিষয়ক একটি কর্মশালা গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালায় বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ থেকে ৩৭জন যুব সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার বিষয়বস্তু ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদেরকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা অথবা উন্নয়ন নিয়ে যুবদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন জনাব গোলাম রব্বানী, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক প্রান্তজন।