উপস্থাপনা

করোনা অতিমারি জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতির সৃষ্টি করেছে। সমগ্র বিশ্ব যখন এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশও সে অনিশ্চয়তার ফল ভোগ করছে। বিশেষত, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়েছে। পিছিয়ে পড়া মানুষ নতুন করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ অবস্থায় কিছুদিনের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হবে। এই প্রেক্ষাপটে ১৬ মে ২০২২ তারিখে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ, একটি মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), মিডিয়া ব্রিফিংয়ের মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ২০১৮-১৯ ছিল সর্বশেষ স্বাভাবিক অর্থবছর। অতিমারির জন্য বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট সরবরাহ শৃঙ্খলের ভাঙন, জ্বালানি ও খাদ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও সর্বশেষ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কাজেই এই বাজেটের মাধ্যমে অতিমারিপূর্বকালের স্বাভাবিকতায় ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।

সার্বিকভাবে এই পরিস্থিতিগুলো মোকাবিলা করতে মূল্যস্ফীতিকে কেন্দ্রীয় চলক বিবেচনা করে নীতিমালা গ্রহণ করার বিকল্প নেই। অতিমারিউত্তরকালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতীয় সঞ্চয়ের হারও হ্রাস পেয়েছে। তাই, জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি করতে সুদের হার বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি। তিনি আরও মনে করেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বিশেষ প্রয়োজনগুলোকে আমলে নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা জরুরি, কেননা সামষ্টিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার মুখে এই জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব নিরসনে যুবদের জন্যে মাথাপিছু ১০০০ টাকা ভাতা প্রদানের প্রস্তাবও করেন তিনি।

মিডিয়া ব্রিফিংয়ের সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) । তিনি বলেন, যে কোনো গড় মান নিয়ে আমাদের এক ধরনের রাজনৈতিক উৎসাহ আছে। তাই গড় হিসাবে আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ে, দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হয়। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি জনগণের জীবনমানের কতটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়, সেটা আলোচনার বাইরে থেকে যায়। বাজেটের সার্বিক দিক, সামষ্টিক অর্থনীতির চিত্র ও অর্থব্যবস্থাপনা – ইত্যাদি বিষয়কে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমানের আলোকে বিশ্লেষণ করাই আজকে মিডিয়া ব্রিফিংয়ের উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করেন তিনি। এই মিডিয়া ব্রিফিং থেকে চিহ্নিত সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলোর আলোকে প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহ নীতি নির্ধারক মহলে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

জনাব টনি মাইকেল গোমেজ, পরিচালক, টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম, এডভোকেসি ও যোগাযোগ, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, বলেন, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য শিশু-উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। বিগত বাজেটগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অনেকক্ষেত্রেই শিশুদের বাজেটের জন্য প্রয়োজনীয় লাইন আইটেম থাকে না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া সম্ভব হয় না; আবার বরাদ্দ থাকলেও সেগুলো যথেষ্ট নয়। বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হওয়াকে তিনি আরও বড় সমস্যা হিসেবে মনে করেন। এজন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় খুব জরুরি। তিনি আরও বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অতিমারির জন্য অনেক শিশুই স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। ফলে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ দুটোই বেড়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘসময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের শেখার ক্ষমতা নষ্ট হয়েছে। তাই এসব সমস্যা সমাধানে বাজেটে যথাযথ বরাদ্দের পাশাপাশি আলাদাভাবে শিশু অধিদপ্তর গঠন করতে হবে।

 অতিমারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্বাস্থ্যখাত। তাই বাজেটে এই খাতের জন্য যথাযথ দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি। এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, . রুমানা হক, বলেন, স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামোকেন্দ্রিক বাজেট বরাদ্দ হওয়া যথেষ্ট নয়। অবকাঠামোকে সচল রাখতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। তাছাড়া অসংক্রামক রোগের ব্যয় দিনদিন বাড়ছে। কাজেই বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। গবেষণার জন্য গত অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সেটি ব্যয় করা হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাই বরাদ্দকৃত অর্থগুলো সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা সেটির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত খাতের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

 মিজ ফেরদৌস আরা বেগম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড), বলেন, বাজেটে ব্যক্তিখাতের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও নীতিমালা গৃহীত হলেও সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হতে দেখা যায় না। ফলে এটি উদ্যোক্তাদের ব্যবসার ব্যয় বাড়িয়ে দেয় এবং তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে অনুৎসাহিত করে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ব্যক্তিখাতে দ্রুত প্রণোদনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসায়িক কর যদি কমানো হয়, তাতে জাতীয় রাজস্ব কিছুটা কমলেও ব্যক্তিখাতের লাভের পরিমাণ হয় বেশি, যা নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান – দুটোই তৈরি করতে সক্ষম।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেট কেমন হওয়া উচিত? – এই বিষয়ে আলোকপাত করেন জনাব সঞ্জীব দ্রং, সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। তিনি মনে করেন, প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ছে। কিন্তু সেই হারে প্রান্তিক আদিবাসী, দলিত ও চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হচ্ছে না। নীতিমালাগুলো মূলধারার মানুষকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয় বলেই এমন হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবেই শোষণ ও অন্যায়ের শিকার হয়ে আসছে। এমনকি অতিমারিকালে আদিবাসীদের আয় ৯২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তাই আদিবাসীদের জন্য ৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি খাতে দলিত ও আদিবাসীদের যথেষ্ট অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ রাখতে প্রস্তাব করেন তিনি।

মিজ ফারাহ কবির, কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ, বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ও মানে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই পরিবর্তনের অভিঘাত বহন করতে হয় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রান্তিক গোষ্ঠীর। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যাদের স্থানান্তরিত হতে হয়, তাদের প্রয়োজনগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। একই কারণে যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি হয়, সেগুলো আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। সম্ভাব্য ভুক্তভোগীদের জন্য জলবায়ু বীমা চালু করতে হবে। তিনি মনে করেন, স্থানীয় সরকারের বাজেট বরাদ্দ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আমলে নিয়ে তৈরি করা উচিত।

আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ , সমন্বয়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ। উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বাজেট নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মঞ্চ থেকে আলোচনা হলেও, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম মূলত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আশা-প্রত্যাশার জায়গা থেকে আজকের আলোচনাটি করবে। তিনি উল্লেখ করেন, বিগত ১৭ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম একটি ভার্চুয়াল সংলাপের আয়োজন করে যেখানে বিভিন্ন শ্রেণির পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও তাদের প্রতিনিধিরা অংশ নেয় এবং বাজেট থেকে তাঁদের আশা আকাঙ্খার কথা তুলে ধরেন। সামগ্রিকভাবে তাদের সমস্যা, চ্যালেঞ্জ ও আশা-আকাঙ্খা এবং বাজেটের সাথে জড়িত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশ্লেষণই এই মিডিয়া ব্রিফিংয়ের মূল আলোচ্য বিষয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।