টেইক ব্যাক দ্যা টেক বাংলাদেশ চ্যাপ্টার

টেক ব্যাক দ্য টেক (টিবিটিটি) হ’ল প্রত্যেকের, বিশেষত মহিলা ও মেয়েদের বিরুদ্ধে অনলাইন সহিংসতা অবসানের জন্য প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের আহ্বান। এটি একটি বিশ্বব্যাপী, সহযোগিতামূলক প্রচারণার প্রকল্প যা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গবেষণা এবং সমাধানের পাশাপাশি মহিলাদের বিরুদ্ধে প্রযুক্তি সম্পর্কিত সহিংসতার সমস্যা তুলে ধরে। বাংলাদেশের পক্ষে এই প্রচারণার কাজ করে আসছে টেইক ব্যাক দ্যা টেক বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।

২০১৪ সাল থেকে বৈশ্বিক অংশীদার হিসাবে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক “টেইক ব্যাক দ্য টেক” এর বাংলাদেশ অধ্যায় এর কাজ শুরু করে। টেইক ব্যাক দ্য টেক হল একটি সহযোগিতা মূলক প্রচার প্রকল্প যা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের উপর হওয়া প্রযুক্তি সংক্রান্ত সকল ধরনের সহিংসতার সমস্যা সমূহ তুলে ধরে এবং সেগুলো সমাধানের জন্য সহযোগিতা করে। এই ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ওপেনসোর্স নেটওয়ার্ক নারীদের কাছে নিরাপত্তা বিষয়ক সকল ধরনের তথ্য সরবরাহ করার চেষ্টা করে থাকে।

বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের নগর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত বেশ কিছু কার্যক্রম সফল ভাবে আয়োজন করে।

কোভিড-১৯ প্রতিক্রিয়ায় টেইক ব্যাক দ্যা টেক এর কার্যক্রম

বিগত কয়েক দশকে তথ্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বৈশ্বিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় প্রযুক্তিগত কার্যক্রমের বিস্তার ঘটেছে বহুগুণে। ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতি এই তথ্য প্রযুক্তির পরিধিকে আরো বিশালতা দিয়েছে। এ বছর মহামারীর এই ক্রান্তিকালে শিক্ষা কার্যক্রম, অফিস, দৈনন্দিন কেনাকাটা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কার্যক্রমও হয়ে পড়ছে অনলাইন নির্ভর। কিন্তু একই সাথে বেড়েছে অনলাইন নিরাপত্তা ঝুকির হার। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার এখন অনলাইন জগতে সহিংসতার ঘটনাকে প্রভাবিত করছে।

আর নারীরা এই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন সবচেয়ে বেশী। বেসরকারি সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এর এক জরিপে উঠে এসেছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের বেশি নারী কখনো না কখনো অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এই সমস্যার প্রতিকারে বাংলাদেশে নারীদের অনলাইন ব্যবহারে সচেতন করতে এবং অনলাইনে নারী সহিংসতা রোধ করতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) এর টেইক ব্যাক দ্যা টেক বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।

এ বছর অনলাইনে নারী সহিংসতা রোধে বেশ কিছু অনলাইন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে টেইক ব্যাক দ্যা টেক। এই বছর ২০২০ টেক ব্যাকের প্রথম কার্যক্রমটি ২৩ শে জানুয়ারী সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে শুরু হয়।  বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর অংশগ্রহণে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। কর্মসূচিতে নারী শিক্ষার্থীদের সাইবার ঝুঁকি এবং প্রতিকারের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছিল।

২০২০ সালে প্রথম সফল ইভেন্টটি শেষ করার পরে, টিবিটিটি এরকম আরও কিছু ইভেন্টের আয়োজন করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু বিশ্বজুড়ে মারাত্মক মহামারী পরিস্থিতি শুরু হওয়ার কারণে জনসমাবেশ এড়াতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়মগুলি মান্য করতে টিবিটটি-এর সমস্ত কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালনা করা হয়। এতে সবচে বড় সুবিধা যা হয়েছে তা হল হাতে কলমে অনলাইনের সঠিক ব্যবহার এবং নিরাপত্তার খুটিনাটি সকলের কাছে ব্যখ্যা করা সহজ হয়েছে।

সমস্ত মানুষ যখন বিশ্বের সমস্ত সংবাদ সম্পর্কে নিজেকে আপডেট রাখার জন্য অনলাইনের উপর নির্ভর করতে শুরু করে তখন সাইবার ওয়ার্ল্ডের সমস্যাগুলি আরও বেড়ে যায়। এজন্য সামাজিক মিডিয়াতে লাইভ সেশনগুলির মাধ্যমে সাইবার সুরক্ষা সম্পর্কিত তথ্য প্রচার শুরু করে টেইক ব্যাক দ্যা টেক। আয়োজনগুলোতে উঠে আসে- ফেক লিঙ্ক এবং সাইবার ক্রাইম থেকে সুরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা, অনলাইন হয়রানি, অপরাধ, এবং সমাধান, সাইবার বুলিং, সাইবার অপরাধীদের মনোবিজ্ঞান, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাষা ব্যবহারের পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়।

আয়োজনগুলোতে অংশ নেন- টেইক ব্যাক দ্য টেকের সমন্বয়কারী মাহবুবা সুলতানা, ঢাকা মহানগর পুলিশ এর সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার জনাব সৈয়দ নাসিরুল্লাহ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ হেলাল উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, যোগাযোগ ব্যাধি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন শান্তা তাওহিদা প্রমুখ।

প্রতি বছর টেইক ব্যাক দ্যা টেক-এর সর্ববৃহৎ প্রচারণার একটি অংশ হল ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ দিনব্যাপী কার্যক্রম। এ বছরেও বিভিন্ন অনলাইন সেশনের মধ্য দিয়ে আয়োজিত হয় এই কার্যক্রম। ২৫ নভেম্বর ১৬ দিনব্যাপী ক্যাম্পেইনের প্রথম আয়োজন হিসেবে টেইক ব্যাক দ্যা টেকের পেজে প্রকাশিত হয় একটি সচেতনতামূলিক ভিডিও যার মূল বিষয়বস্তু ছিলো অনলাইনে নিরাপদ থাকতে হলে অনলাইনে আচরণ কেমন হবে, কিভাবে অনলাইন ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি সম্পর্কে। মূলত এই কন্টেন্টের মাধ্যমেই ভার্চুয়ালি যাত্রা শুরু হয় এবছরের ১৬ দিনের ক্যাম্পেইন। ২৬ নভেম্বর আয়োজিত হয় অনলাইন সহিংসতা এবং অনলাইনে নিরাপদ থাকার উপায় সম্পর্কিত একটি অনলাইন সেশন। এছাড়াও অনলাইন আচরণগত সচেতনতা কিভাবে অনলাইন সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারে তা নিয়ে ২৯ নভেম্বর একটি অনলাইন আলোচনায় অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের আইন কি বলছে অনলাইন সহিংসতা সম্পর্কে আর কীভাবেই বা আইনি সহায়তা পাওয়া যেতে পারে এই সংক্রান্ত একটি অনলাইন আয়োজনে ১লা ডিসেম্বরে ক্যাম্পেইনে অংশ নেন গ্লোবাল ইয়ুথ এমপাওয়ারমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন এর লিগ্যাল এফেয়ার্স এর প্রধান জোবায়দা ইউসুফ মীম।

সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়া ব্যাক্তির মানসিক বিপর্যয় নিয়ে আলোচনা করতে ৩ ডিসেম্বর একটি অনলাইন সেশনে অংশ নেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ  এর সহযোগী অধ্যাপক ড. মেখলা সরকার।

৫ ডিসেম্বর একটি অনলাইন ওয়েবিনার এর মাধ্যমে দেখানো হয় সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন সাইট ব্রাউজিং এর সময় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের খুটিনাটি সম্পর্কে।

৭ ডিসেম্বর টেইক ব্যাক দ্যা টেক এবং বাংলাদেশের রেডিও চ্যানেল ঢাকা এফএম ৯০.৪ এর যৌথ উদ্যোগে ইন্টারনেট হ্যারাসমেন্ট এবং এর প্রতিকার শীর্ষক একটি অনলাইন সেশন আয়োজিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন- সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট কমিশনার সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ জনাব সায়েদ নাসিরুল্লাহ, টিবিটিটি বাংলাদেশ চ্যাপ্টার এর প্রধান সমন্বয়ক এবং প্রথম আলো ট্রাস্ট এর সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা,  এডভোকেসি এন্ড ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশ রেসকিউ কমিটি এর প্রধান সাবিরা নুপুর।

অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উদ্যোগে এবং প্রথম আলোর সহোযোগিতায় আয়োজিত হয় একটি অনলাইন সেশন। আয়োজনের প্রধান বিষয়বস্তু ছিলো অনলাইনে নারী, শিশু-কিশোর এবং যুবকদের নিরাপত্তা। আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ পরিচালক (গার্লস রাইটস) এর কাশফিয়া ফিরোজ। আয়োজনে অংশ নেন শিক্ষার্থী লাবণ্য প্রজ্ঞা,  আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সাদাত রহমান, টেইক ব্যাক দ্যা টেক বাংলাদেশ সমন্বয়ক এবং প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা এবং সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট কমিশনার সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ জনাব সায়েদ নাসিরুল্লাহ। টেইক ব্যাক দ্যা টেক বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের পেজে ৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় অন্য একটি ভিডিও বার্তা। যেখানে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি এর নিরাপত্তা নিয়েও যথেষ্ট সচেতনতা তৈরী করার আহবান জানানো হয় প্রত্যেক নারী পুরুষকে।

এছাড়াও ইউনিসেফ বাংলাদেশের আয়োজনে ও গ্রামীণফোনের সহযোগিতায় “ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকের অনলাইন সুরক্ষাঃ চ্যালেঞ্জ ও করণীয়” শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে অংশ নেয় টেইক ব্যাক দ্যা টেক। ভার্চ্যুয়াল সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

ভবিষ্যতের ভাবনা

সময়ের সাথে প্রযুক্তির নানাবিধ ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা আরো বেগবান হবে। সেক্ষেত্রে অনলাইন সহিংসতা এড়াতে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। টেইক ব্যাক দ্যা টেক কার্যক্রম মনে করে, শিক্ষাব্যবস্থা যেহেতু এখন অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছে, তাই সচেতনতার জায়গা এখান থেকেই শুরু হওয়া বাধ্যতামূলক। টিবিটিটি মনে করে-

  • স্কুল পর্যায় থেকে অনলাইন ভিত্তিক দক্ষতা এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করা জরুরী। প্রয়োজনে একে পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
  • প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার এর ক্ষেত্রে কঠোর পর্যবেক্ষন ব্যবস্থা নিশ্চিত প্রয়োজন।
  • স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সচেতনতা মূলক কার্যক্রম কে আরো জোরদার করা দরকার।
  • সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ।
  • টেইক ব্যাক দ্যা টেক এর কার্যক্রম কে লোকাল লেভেল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত মানুষের কাছে পৌছানো প্রয়োজন।

 

আমাদের সামাজিক মাধ্যম

টেইক ব্যাক দ্যা টেক বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের একটি বাংলাদেশভিত্তিক সামাজিক কার্যক্রম যা আন্তর্জাতিক টেইক ব্যাক দ্যা টেক কে সমর্থন করে। টিবিটিটি কার্যক্রমের বিস্তারিত মিলবে- https://bdosn.org/programs/tbtt ; ফেসবুক গ্রুপে আমাদের সাথে যুক্ত হতে- https://www.facebook.com/groups/246166789306874/; আমাদের ফেসবুক পেজ- https://www.facebook.com/tbttbd