নাগরিক প্ল্যাটফর্ম তার বিভিন্ন কার্যক্রমের সূত্রে লক্ষ্য করেছে যে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও নানারকমের চ্যালেঞ্জ জাতীয় পর্যায়ে দৃষ্টিগোচর হয় না। এসব বিষয় জাতীয় গণমাধ্যমেও সেভাবে উঠে আসে না। এ বিষয় নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় অনেকেই মন্তব্য করেন যে—সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সমস্যা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জাতীয় পর্যায়ে দৃশ্যমান করার জন্য স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও যেসব যুবরা সাংবাদিকতা পেশায় আসছেন তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলে তারা স্থানীয় বিষয়গুলোকে দক্ষতার সাথে তুলে ধরতে পারবে বলেও আলোচকরা উল্লেখ করেন।

এসব আলোচনার আলোকে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম স্থানীয় পর্যায়ের যুব সাংবাদিকদের নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে ঢাকায় ‘যুবদের জন্য উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ শীর্ষক একটি কর্মশালার আয়োজন করে। দিনব্যাপী এই কর্মশালায় সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৩৭ জন যুব সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন।

স্থানীয় সাংবাদিকদের সংবাদ প্রচারে বিভিন্ন আঙ্গিক ও কৌশলের সাথে পরিচিতিকরণ, মানসম্পন্ন কন্টেন্ট (ব্লগ, ভ্লগ ও রিলস্) তৈরি, স্থানীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সংবেদনশীলভাবে সংবাদ প্রচার এবং স্থানীয় বাস্তবতা সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে মিডিয়া গেট কিপারদের অবহিত করা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।

সাংবাদিকদের স্বাগত জানিয়ে অধিবেশন শুরু করেন জনাব তৌফিকুল ইসলাম খান, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। কর্মশালার উদ্দেশ্য ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-এর কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি। তিনি সাংবাদিকদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করেন। সাংবাদিকরা তাদের নিজ নিজ এলাকার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ তৈরি এবং প্রচার কৌশল নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের সাথে আলোচনা করেন।

কর্মশালায় ‘স্থানীয় বাস্তবতাকে জাতীয় পর্যায়ে উপস্থাপন’- অধিবেশনে প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব ইনাম আহমেদ, সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এবং জনাব শওকত হোসেন মাসুম, হেড অফ অনলাইন, দৈনিক প্রথম আলো। এই অধিবেশনে অংশগ্রহনকারীদের ‘স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ের সংবাদ জাতীয় গণমাধ্যমে প্রাধান্য না পাওয়ার চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ে একটি দলীয় কাজ দেওয়া হয়। দলীয় কাজে স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার একাধিক সমস্যা উঠে আসে যার মধ্যে প্রধান কিছু বাধা হলো— স্থানীয় সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা মনে না করা, তথ্য প্রাপ্তির সমস্যা, সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব, স্থানীয় সাংবাদিকের শ্রমের অবমূল্যায়ন, প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে একতার অভাব, প্রতিযোগীতামূলক মানসিকতা এবং নারী সাংবাদিকদের পিছিয়ে রাখার মানসিকতা ইত্যাদি।

সাংবাদিকতার এই সকল বাধার আলোকে জনাব ইনাম আহমেদ মন্তব্য করেন, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা এখন কেন্দ্রীয়ভাবে সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো আইন দিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় নতুন করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং, সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ভুল তথ্য যেন প্রকাশিত না হয় সেই দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ক্লিক বেইট অথবা ডিপফেক থেকে দূরে থাকতে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। সবশেষে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন। অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন জনাব অভ্র ভট্টাচার্য, যুগ্ম পরিচালক, সংলাপ ও প্রচার, সিপিডি।

জনাব শওকত হোসেন মাসুম স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদকে কীভাবে জাতীয় গণমাধ্যমের মনযোগে আনা যায় সেই বিষয়ে কিছু পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি বলেন, স্থানীয় সংবাদে তথ্যের ঘাটতি এবং পরিবেশন শৈলীতে দূর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। তাই সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সৃজনশীল হতে হবে যাতে তা পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। চারণ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত মোনাজাতউদ্দিন-এর লেখনীর উদাহরণ দিয়ে তার গল্প বলার ঢঙকে অনুসরণ করার পরামর্শ দেন তিনি।

পরবর্তী অধিবেশনে জনাব প্রণব সাহা, সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ সাংবাদিকদের কাছে থেকে বার্তাকক্ষের সাথে তাদের সমস্যা এবং অন্যান্য বাধা সম্পর্কে জানতে চান। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ‘ভাইরাল’ সংবাদ তৈরি করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন সকল সংবাদে তথ্য থাকবে কিন্তু সকল তথ্য সংবাদ হতে পারে না। প্রকৃত তথ্য পেতে তিনি তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারে পরামর্শ দেন।

জনাব অনন্ত ইউসুফ, হেড অফ মাল্টিমিডিয়া, দ্য ডেইলি স্টার সাংবাদিকতায় ডিজিটাল মাধ্যম এর কার্যকর ব্যবহার এবং কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করেন। ডিজিটাল মাধ্যমে ব্লগ, ভ্লগ রিলস তৈরি করে কী উপায়ে অধিক সংখ্যক মানুষের কাছে দ্রুত সময়ে পৌঁছানো যায়, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।

উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের মাঝে সনদ বিতরণ করে ও প্রশিক্ষকদের ধন্যবাদ জানিয়ে সমাপনী বক্তব্য রাখেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন— দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জাতীয় পর্যায়ে তুলে আনার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতা করছেন তারা গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি আরও বলেন আমরা যদি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কথা বলি তাহলে খুব দ্রুতই তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তারা আর পিছিয়ে থাকবে না। সাংবাদিকদের এই অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

কর্মশালা শেষে অংশগ্রহনকারীরা কর্মশালা সম্পর্কে তাদের মতামত জানান এবং এ ধরনের আয়োজন আরও বেশি বেশি আয়োজন করার আহ্বান জানান।