প্রকৃতি তার নিজস্ব খেয়ালে সৃষ্টি করলেও, পরিবার বা সমাজ আপন করেনি কখনও। নিজ ঘরে মেলেনি আশ্রয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা’র মতো মৌলিক পাঁচটি চাহিদাগুল ঠিকঠাক না পেয়েে চলছে তাদের জীবন। তৃতীয় লিঙ্গের হলেও নারী কিংবা পুুরুষ পরিচয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হয়, জন্মই যেন তাদের আজন্ম পাপ। গল্পটি যশোরের হিজড়া জনগোষ্ঠীর।
যশোর সদরসহ আটটি উপজেলার সাড়ে তিনশজন হিজড়া পার করছেন মানবেতর জীবন। শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ না থাকায়, পরবর্তী প্রজন্মেও চিরাচরিত নাচ-গান পেশাতেই চলছে তাদের জীবন। ক্রমান্বয়ে সে জায়গাও সংকুচিত হতে থাকায় হতদরিদ্র জীবন-যাপন করছেন তারা। যশোর সদরসহ আটটি উপজেলায় থাকা হিজড়াদের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেও সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেন একশজন হিজড়া। যার মধ্য ৮৫ জন ভোট দেন নারী ও পুরুষ পরিচয়ে। তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়ে ভোট দেন ১৫ জন। যশোর-১ (শার্শা) আসনে ভোট দেন ২ জন হিজড়া। যশোর-৩ (সদর) আসনে ভোট দেন ৬ জন, যশোর-৪ (অভয়নগর) আসনে ৪ জন, যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে ২ জন এবং যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে ভোট দেন ১ জন হিজড়া। তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াশুন্য আসন ছিল যশোর-২ (চৌগাছা-ঝিকরগাছা)।
পারিবারিক ও সামাজিক নানান প্রতিকূলতা, হিজড়া দলপতিদের অনিচ্ছা, জনশুমারি ও জাতীয় পরিচয়পত্রে হিজড়াদের নারী ও পুরুষের কাঁতারে অন্তর্ভূক্তির কারনে হিজড়ারা পারছেন না নিজস্ব লিঙ্গ পরিচয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। বিভিন্ন এলাকায় নবজাতকের খোঁজ পেলে বা সামাজিক বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অভিনয় করে, নেচে গেয়ে বিনোদনের খোরাক যুগিয়ে যা উপার্জন করেন তাই দিয়েই চলে তাদের দৈনন্দিন জীবন। পারিবারিক ও সামাজিক বঞ্চনা ও অপমানের বোঝা কাঁধে নিয়ে, শিক্ষা ও চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে যশোরের হিজড়া জনগোষ্ঠী সার্বিকভাবে পিছিয়ে রয়েছেন। মূল স্রোতে আসতে তাদের সামনে হাজারো বাধা। মৃত্যুর পর মেলে না স্বপরিচয়ে জানাজা, দাফন বা সৎকারের সুযোগটিও। হিজড়া পরিচয় গোপন করে মৃতদেহের দাফন বা সৎকার করা হয়। পরিচয় প্রকাশ পেলে জানাজা ও দাফনে অস্বীকৃতি জানায় মাওলানা ও সাধারণ মানুষ। শহর ও গ্রামাঞ্চল উভয় জনপদেই তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। নেই খুব একটা রাষ্ট্রীয় সহযোগিতাও। সরকারি ভাতা পেতে হিজড়াদের পৌঁছতে হয় ৫০ বছর বয়সে। মাসিক এ ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা। যৎসামান্য এ ভাতা ও ভাতাপ্রাপ্তির বয়সসীমা ৩০ বছরসহ অধিকার এবং বিভিন্ন দাবি দাওয়া পূরণ না হওয়ায় হতাশা রয়েছে যশোরের হিজড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে, এমনটি জানিয়েছে তাদের নিয়ে কাজ করা এনজিও প্রতিষ্ঠান অর্পণ মানব কল্যাণ সংস্থা ও আইইডি যশোর।
যা বলছেন হিজড়া জনগোষ্ঠী
শহরের রেলরোড এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের জহুর হোসেন বলেন, এবারের জাতীয় নির্বাচনে (দ্বাদশ) ভোট দিতে আমার কেন্দ্রে গেলে আমাকে দুইবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয় আমার নাম ওই কেন্দ্রের তালিকায় নেই। অথচ ওটা আমার কেন্দ্র নিশ্চিত হয়েই আমি সেখানে যাই। এমন হয়রানি শেষে এক সাংবাদিক ও এনজিও কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তৃতীয়বারে আমি ওই কেন্দ্রে ভোট দিতে সক্ষম হই। আমি তবু নিজ লিঙ্গপরিচয়ে ভোট দিতে পারছি। বেশিরভাগ হিজড়ারা নারী বা পুরুষ পরিচয়ে ভোট দেন।
ষষ্টীতলার তাপসী দে চাঁদনী বলেন, “শিক্ষা ও চাকরিতে আমাদের সুযোগ অনেক কম। এখন শিশু জন্মহারও আগের চেয়ে কমে গেছে, যে কারনে আমরা প্রায় কর্মহীন। কোন জায়গায় শিশু জন্ম নেয়ার পর সেখানে গেলে মানুষ আজকাল আমাদের তাড়িয়ে দেয়, দুর্ব্যবহার করে। অনেকে আবার বাচ্চা নিয়ে নাচ গান করার পরে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে। খেয়ে না খেয়ে আমাদের জীবন কাটছে। গ্রামাঞ্চলের হিজড়াদের অবস্থা আরও খারাপ। চুড়ামনকাটি এলাকার জনি কুমার দাস বলেন, আমরা তো জন্মগতভাবেই আলাদা। জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে ভাতা পাই আমরা। ৫০ বছর বয়সে কেন আমাদের ভাতা দেয়া হবে? এখন আগের মতো আর আয় রোজগার হয় না। আমাদের তো কেউ কোন কাজ দেয় না। আমাদের ভাতা দিলে ৩০ বছর বয়সের মাঝেই দিতে হবে”।
ষষ্টীতলার পায়েল যোগ করেন, “আমার পাঁচ শতক জমি আছে। যা ফিরে পেতে দীর্ঘদিন ধরে আমাকে আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। হিজড়া বলে আমি কারো সহযোগিতা পাই না। অনেক সময় আমাদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে”।
ঘোপ এলাকার গোলাম মোস্তফা নীল বলেন, “ছোটবেলা থেকেই আমার স্কুলে কেউ আমার পাশে বসতে চাইত না। আমার কারণে আমার বাবা মাকে আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীরা অপমাণ অপদস্ত করে। এখন আমি যশোর সরকারি এম.এ কলেজে অনার্স পড়ছি। আমার কোন বন্ধু-বান্ধব নেই। আমার সাথে কেউ মেশে না। শিক্ষকদের কাছ থেকে অন্য শিক্ষার্থীদের মতো ভালো ব্যবহার আমি পাই না। ক্লাস শেষে মাঝে মাঝে পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকি। তারপর বাড়ি ফিরে যাই”।
বেজপাড়ার বাসিন্দা ফাবিহা বুশরা বলেন, “এক বছর হলো আমার বিয়ে হয়েছে। বাবা মায়ের সাথে থাকা অবস্থায় আত্মীয়–স্বজন, প্রতিবেশীরা আমার বাবা–মাকে নানাভাবে অপমাণ অপদস্ত করতো। এখনও নানা ধরণের কথা শুনতে হয়। অনার্স পড়তে পড়তেই আমার শিক্ষাজীবন থেমে যায়। বর্তমানে সংসার করছি। জানি না শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবো কিনা”।
যা বলছে এনজিও প্রতিষ্ঠান
এনজিও প্রতিষ্ঠান অর্পণ মানব কল্যাণ সংস্থা যশোরের সমন্বয়কারী রুবাইদুল হক সুমন বলেন, “আমরা কয়েকটি প্রধান সমস্যাকে চিহ্নিত করে দাবি দাওয়া তুলে ধরছি প্রশাসন ও সরকারের কাছে। হিজড়ারা ৫০ বছরে ভাতা পান। এ ভাতা যাতে তারা ৩০ বছরে পান আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি। এছাড়া শিক্ষা, চাকরিতে তারা যাতে সুযোগ পান আমরা সে বিষয়েও চেষ্টা করে যাচ্ছি। পরিবার, সমাজ ও প্রসাশনের সার্বিক সহযোগিতা পেলে হিজড়া সমাজ এগিয়ে যাবে”। এনজিও প্রতিষ্ঠান আইইডি যশোরের ব্যবস্থাপক বীথিকা সরকার বলেন, “সার্বিকভাবে যশোরের হিজড়ারা ভালো নেই। বিভাগীয় শহরগুলোতে তারা কিছুটা সুবিধা পেলেও জেলা, উপজেলা বা গ্রামাঞ্চলে তারা সুবিধা বঞ্চিত। শিক্ষা চাকুরির ক্ষেত্রে তারা বরাবরই উপেক্ষিত। এ বিষয়ে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেলে তারা এগোতে পারবে।”
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ‘যুবদের জন্য উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ বিষয়ক একটি কর্মশালা গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালায় বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ থেকে ৩৭জন যুব সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার বিষয়বস্তু ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদেরকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা অথবা উন্নয়ন নিয়ে যুবদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়।
এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন মিনা বিশ্বাস, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক গ্রামের কাগজ।
Leave A Comment