সম্প্রতি বাংলাদেশের সরকারি দায়-দেনার পরিমাণ ও সেটি পরিশোধ করার সক্ষমতা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। প্রথমত, বিগত সময়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধের সময় এগিয়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, দায়-দেনা নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কায় উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই আলোচনা আরও গতি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ০৯ মে, ২০২২ তারিখে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এবং আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ একটি ভার্চুয়াল আলাপচারিতায় যুক্ত হন। আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের বিগত দুই দশকের তথ্য ও উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা, বর্তমান পরিস্থিতি এবং এর ভবিষ্যত কী? – এই বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করেন।
তিনি বলেন, অতিমারি উত্তরকালে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে যে ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে উদ্ভূত বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং দেশীয় মুদ্রার অবনমনের পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক দায়-দেনা পরিশোধের আলোচনা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেননা, দায়-দেনার পরিমাণ অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক – যেমন: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাছাড়া, দায়-দেনা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংকটেরও জন্ম দেয় যা শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতার আলোকেই যাচাই করা যেতে পারে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক – মোটাদাগে এই দুই ভাগে বাংলাদেশের ঋণকে দেখা হলেও প্রচলিত সরকারি হিসাব ও তথ্য দায়-দেনার সম্পূর্ণ চিত্রকে সামনে নিয়ে আসে না। কারণ, জাতীয় অনেক প্রচ্ছন্ন দেনাই বাজেটে পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় না। সরকারি তথ্য ও উপাত্তের বিশ্লেষণ থেকে এটি স্পষ্ট যে, চলমান দশকে দেনার ভার বিগত দশকের তুলনায় দেড় গুণ বেশি যা ভবিষ্যতে আরও ঊর্ধ্বমূখী হবে বলেই মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এর ফলে বৈদেশিক দেনা পরিশোধের চাপ সামনের বছরে আরও বাড়বে। এর পেছনে, দেশজ সম্পদের অপ্রতুলতা, বৈদেশিক লেনদেনে দুর্বলতার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঋণ গ্রহণে সরকারের যথেষ্ট প্রজ্ঞার অভাবকে দায়ী করেন তিনি।
বিগত দশকে বৈদেশিক খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়ে থাকলেও চলমান দশকে সামগ্রিক দায়-দেনা গ্রহণের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ খাত বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। চলমান দশকে এখন পর্যন্ত মোট ঋণের ৫৪ শতাংশ অভ্যন্তরীণ খাত থেকেই নেওয়া হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে নির্বাচনপূর্ব ও ঠিক নির্বাচন পরবর্তীকালে সাধারণত ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সরকারি তথ্য বলছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে এ ধারা পরিলক্ষিত হয়েছে। শুধু যে দায়-দেনার পরিমাণই বাড়ছে এমন নয়। একইসাথে বাড়ছে এই দেনা পরিশোধের খরচ ও সুযোগ ব্যয়ও।
এই প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে ৭৪ লক্ষ জনগোষ্ঠীর আয়কর সনদ থাকলেও, কর দেয় মাত্র ২৩ লক্ষ মানুষ। আমাদের দেশজ উৎপাদনের সাপেক্ষে কর আহরণের হার ১০ শতাংশেরও নিচে, যা প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ কম। এতে অভ্যন্তরীণ দেনা পরিশোধ করার জন্য একদিকে যেমন কিছু সংখ্যক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সরকারকে বাধ্য হয়েই ব্যয়বহুল উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। অন্যদিকে, নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হবার কারণে এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হতে যাবার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে বিভিন্ন ঋণ সুবিধা পাবার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। তাছাড়া অতিমারি উত্তরকালে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বিনিময়ে টাকার অবনমন হয়েছে। সুতরাং বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাব ঘাটতির পাশাপাশি বাণিজ্য ঘাটতির ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। এই ধরনের ধাক্কা মোকাবিলার জন্য সরকারের শেষ অবলম্বন তথা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ – সেই জায়গাটিও সংকুচিত হয়েছে।
তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছু শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। দেশীয় মুদ্রার অবনমনের ঝুঁকি, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক – উভয় খাত থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদের হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুদের হার বাড়লে প্রকল্প ব্যয়ও বাড়বে। সেক্ষেত্রে বর্ধিত ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্প আর্থিক ও অর্থনৈতিকভাবে কতটুকু লাভজনক হবে – সেটি গবেষণালব্ধ বিষয় হিসেবে আপাতত থেকেই যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয়, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের সাপেক্ষে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। আগামীতেও এই ক্রমবর্ধমান প্রবণতা থাকার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে এ বিষয়টি আগামী দিনের উন্নয়ন পরিকল্পনার বাইরে রাখা যাবে না।
কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বাস্তবতা শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির মত হবে না বলেও মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, দুইটি দেশের কাঠামো ভিন্ন। তাই এদের সরাসরি তুলনা করার সুযোগ নেই। তবে শ্রীলঙ্কার জটিলতা থেকে শিক্ষা নেওয়াটা বাংলাদেশের জন্য জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির উপযুক্ত সংমিশ্রণ খুব জরুরি। তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপুর্ণ হচ্ছে আর্থিক সংহতিকরণ। অর্থাৎ দায়-দেনা পরিশোধের জন্য নতুন করে ঋণ গ্রহণ করার সাথে সাথে কর আহরণের মাত্রা বাড়াতে হবে এবং আদায়কৃত করের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এছাড়াও, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা করতে রেমিট্যান্স খাতকে গুরুত্ব ও সুরক্ষা – উভয়ই দিতে হবে। সেই সাথে রপ্তানি অব্যাহত রাখতে ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের দায়-দেনা পরিস্থিতির একটি স্বচ্ছ ও নিয়মিত মূল্যায়ন জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।
আলোচনার শেষে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।