Download Keynote Presentation

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ, “বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ” উদ্যোগের অংশ হিসেবে ‘নাগরিক ইশতেহার’ প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছে। এই ইশতেহারে স্থানীয় অংশীজনদের মতামত ও সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করতে দেশের আটটি অঞ্চলে আয়োজন করা হবে আঞ্চলিক পরামর্শ সভা। একই সাথে তরুণ প্রজন্মের মতামত তুলে ধরতে কর্মশালার আয়োজন করা হবে সারাদেশব্যাপী মোট ১৭টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে।

এই প্রেক্ষাপটে ২৩ অক্টোবর ২০২৫ তারিখ নাগরিক প্ল্যাটফর্ম সিলেটে ইশতেহার বিষয়ক প্রথম আঞ্চলিক পরামর্শ সভার আয়োজন করে। সভার সভাপতিত্ব করেন, নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকবৃন্দ।

সভার শুরুতে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের নেটওয়ার্ক ফোকাল পয়েন্ট মি তারান্নুম জিনান নাগরিক ইশতেহার তৈরির প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তাঁর বক্তব্যে বলেন, অন্তর্বর্তী বা উত্তরণকালীন সময়কে সামনে রেখে নাগরিক আলোচনার এই ধারা আটটি আঞ্চলিক সভার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। তিনি আরও বলেন, গতকাল (২২ অক্টোবর ২০২৫) সিলেটের যুব সমাজের প্রত্যাশা জানতে আমরা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি কর্মশালা করেছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে, তাই নাগরিকদের ভূমিকা এই সময়ে আরও সক্রিয় ও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

ড. দেবপ্রিয় আরো বলেন, গত সরকারের সময় প্রশাসন, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদদের ত্রিমুখী যোগসাজশে একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। যে গোষ্ঠী শুদ্ধতা বা স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করে না। কারণ স্বচ্ছতা এলে প্রতিযোগিতা তৈরি হয় এবং প্রতিযোগিতায় তারা টিকে থাকতে পারে না। এই প্রক্রিয়াকে ইংরেজিতে Kleptocracy বলা হলেও, এর বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে “চামচা পুঁজিবাদ”।

মুক্ত আলোচনার শুরুতে মেন্টিমিটার প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের একটি প্রশ্ন করা হয়—

নির্বাচিত সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?”

উত্তর হিসেবে উঠে আসে

জবাবদিহিতা, আইনের শাসন, সুশাসন, সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি, গুণগত শিক্ষা, নিরাপত্তা, দেশপ্রেম ইত্যাদি।

উন্মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের প্রত্যাশা, মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরেন।

তাঁরা বলেন, অতীতে রাজনীতিবিদরা জনগণের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হননি। আমরা চাই আগামী সংসদ সদস্যরা এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত করা এবং গণমাধ্যমের জন্য চাপমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। একই সাথে অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে পরোক্ষভাবে হলেও আগামী সংসদে প্রতিনিধিত্বের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়।

অংশগ্রহণকারীরা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিৎ সাধারণ বক্তব্যের পরিবর্তে ইস্তেহারে নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতি দেয়া।

দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের কথা উল্লেখ করে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, নতুন সরকারের এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে স্থানীয় প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবও উত্থাপন করা হয়। আলোচনায় কৃষিখাতে অনবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারকারী কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও “জাস্ট ট্রানজিশন” কাঠামোর আওতায় আনার পরামর্শ প্রদান করা হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারি বিষয়ে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে হয়রানি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। তাছাড়াও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন। যুব ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত আলোচনায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) অপব্যবহার রোধে রাজনৈতিক ইশতেহারে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তাও উঠে আসে।

অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের আলোচনায় ব্যাটারি চালিত রিকশা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ায় বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না রাখাকে একটি উদ্বেগজনক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একই সাথে পথশিশুদের অন্তর্ভুক্তি, আঞ্চলিক বিনিয়োগের কার্যকর বাস্তবায়ন এবং সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তার দাবি উত্থাপিত হয়, যাতে প্রত্যেক নাগরিক মানবিক জীবনের অধিকার ভোগ করতে পারেন।

মুক্ত আলোচনায় শিক্ষার প্রসার, শিক্ষিত বেকারত্ব নিরসন, কর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ এবং উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব প্রসঙ্গও আলোচনায় উঠে আসে।

সভার শুরুতে মেন্টিমিটার প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যেই প্রশ্নটি করা হয়েছিল তা সভার শেষে আবার করা হয় এবং অংশগ্রহণকারীদের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা ভিন্নতা দেখা দেয়। দ্বিতীয় পর্বের প্রতিক্রিয়ায় জবাবদিহিতা, নিরাপত্তা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং শেখ হাসিনার বিচারের দাবি বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়।

সভার শেষে, অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি, ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ঘটনাবলি স্মরণ করে বলেন, “আমরা অনেককে হারিয়েছি, তবে নতুন এক প্রজন্মকেও চিনেছি।” তিনি নাগরিক সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, “Eternal vigilance is the price of democracy অর্থাৎ গণতন্ত্র রক্ষার জন্য চিরস্থায়ী সতর্কতা অপরিহার্য।”