এলডিসি উত্তরণের মাপকাঠি অর্জনে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান তথা নাগরিক সংগঠনগুলো (সিএসও) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়াকে মসৃণ এবং টেকসই করার জন্য এ প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অবদান অব্যাহতভাবে প্রয়োজন হবে। এই বিষয়ে পর্যাপ্ত আলোচনার অভাবে জাতীয় নীতিমালাতে তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় না।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এই বিষয়ে গবেষণা করার জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিভাগ থেকে মোট ১০৯ জন উত্তরদাতা এ জরিপে অংশ নেন যার মধ্যে ৭৬.২১% অংশগ্রহণকারীই প্রান্তিক বা ছোট আকারের বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সংগঠনগুলো (সিএসও) যাদের বার্ষিক বাজেট ১২ কোটি টাকার কম। এ জরিপে উঠে আসে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বা নাগরিক সংগঠনসমূহের সামগ্রিকভাবে অর্থায়নের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থায়ন বৃদ্ধি পেলেও এলডিসি তথা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অর্থায়ন কমে যাচ্ছে। জরিপ অনুযায়ী প্রায় ৭০% প্রতিষ্ঠান মনে করে যে সরকারের কাছ থেকে তহবিল লাভের চ্যালেঞ্জসমূহ ভবিষ্যতেও বিরাজ করবে। ফলস্বরূপ, তহবিলের সীমাবদ্ধতা দারিদ্র্য, ক্ষুধা হ্রাস এবং মানসম্মত শিক্ষা বৃদ্ধিতে সিএসওসমূহের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এই জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয় নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এসডিজি -এর উদ্যোগে এবং ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) বাংলাদেশ ও ইউনাইটেড নেশনস পোভার্টি-এনভারমেন্ট অ্যাকশন এর সহযোগিতায় আয়োজিত “বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়ায় নাগরিক সংগঠনগুলোর ভূমিকাঃ সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জসমূহ” শীর্ষক নীতি সংলাপে। সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯ অক্টোবর ২০২২ তারিখে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র (বিআইসিসি)-এ। সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপাধ্যক্ষ ড. মোঃ আব্দুস শহীদ, এমপি, সভাপতি, অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। এ সংলাপটির সভাপতিত্ব করেন মিজ শাহীন আনাম, কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তাঁর মূল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, প্রায়শই নাগরিক সমাজ এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলোর ক্ষেত্রে সরকার কী করবে সেটার উপর গুরুত্বারোপ করে থাকেন, কিন্তু এর ভেতরে নাগরিক সংগঠন এবং বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তিনি বিশেষ করে দোহা প্রোগ্রাম অব একশন এর কথা উল্লেখ করে বলেন বাংলাদেশ সরাসরি এখনো এর কোনো বৈঠকে অংশ না নিলেও এই প্রোগ্রামের কার্যক্রম বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। তিনি আশা ব্যক্ত করে বলেন যে বাংলাদেশ হয়তো আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০২৩-এ সরাসরি দোহা-এ প্রোগ্রামের বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
মিজ শাহীন আনাম, এ সংলাপের সভাপতি হিসেবে বলেন, এলডিসি উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি আলোচনার বিষয় এবং আমাদের জাতীয় জীবনের মাইফলক। নাগরিক সংগঠন প্রতিনিধিদের সবার মনে রাখা উচিত যে আমরা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের ছাপ বা অবদান যেন রেখে যেতে পারি।
প্রধান অতিথি উপাধ্যক্ষ ড. মোঃ আব্দুস শহীদ, এমপি, সভাপতি, অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ তারঁ বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে গবেষণামূলক আলোচনা ও সংলাপগুলোতে সরকারের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণের মাধ্যমে ত্রুটি-বিচ্যুতির জায়গাগুলো জানার মধ্য দিয়ে সেসব বিচ্যুতির জায়গাগুলোতে ভবিষ্যতে সরকার যেন কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করেন।
সংলাপের বিশেষ অতিথি মিজ খুশি কবির, সদস্য, বোর্ড অফ ট্রাস্ট্রিজ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এবং সমন্বয়ক, নিজেরা করি বলেন যে, নাগরিক সমাজ একরূপ। কিন্তু সরকার নাগরিক সংগঠনগুলোকে প্রতিপক্ষ মনে করে। দেশের উন্নয়নে প্রত্যেক নাগরিকের ভূমিকা আছে যা স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সকলকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উন্নয়নের ধারা সকলের ক্ষেত্রে এক নয়, তাই নীতিমালার ক্ষেত্রে ভিন্নতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
ড. নাজনীন আহমেদ, কান্ট্রি ইকোনোমিস্ট, ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) বাংলাদেশ বলেন যে, এ মুহুর্তে বাংলাদেশ এলডিসি পরবর্তী মসৃণ রূপান্তরের কৌশলগত নীতিমালা প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশ এখনো মধ্যম আয়ের ফাঁদের ঝুঁকিতে রয়েছে এবং নাগরিক সংগঠনগুলোর একটি দীর্ঘ রূপান্তর পরিকল্পনা দরকার। কারণ ২০২৬ এর পর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করা যার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি এবং সরকারকেও এখানে অনুদান প্রদানের মাধ্যমে সহযোগিতা করতে হবে।
মিজ ফারাহ কবির, কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ বলেন যে কোভিড অতিমারির জন্য বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই দুই ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রায়শই দুর্যোগপ্রবণতার কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে। এ কারণে দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রতি আরো বেশি নজর দিতে হবে।
জনাব মোঃ হারুন অর রশিদ, নির্বাহী প্রধান, লাইট হাউস বলেন যে,পর্যাপ্ত অনুদানের অভাবে ঢাকার বাইরের শহর এবং গ্রামাঞ্চলের নারীরা উন্নয়ন কর্মে অগ্রসর হতে পারছেন না। তিনি সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং বৃহৎ এনজিওগুলোকে ক্ষুদ্র এনজিওগুলোকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান।
জনাব নেসার আহমেদ, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড এক্সপার্ট, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় বলেন যে, এলডিসি উন্নয়ন প্রক্রিয়া আমাদের দেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি গর্বের বিষয়। এটি আমাদের দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু অপরদিকে তিনি বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্কের হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আশংকা প্রকাশ করেন।
মিজ হোসনে আরা হাসি, প্রধান নির্বাহী, জাগোনারী, বরগুনা বলেন যে, জাতীয় বাজেটে সমতল, পাহাড়, হাওর ইত্যাদি অঞ্চলগুলোকে প্রয়োজনীয় গুরত্বারোপ করা হয়না। এছাড়াও উপকূলে যে জেলেরা আছে তাদের অধিকারের কথা কেউ বলছেনা। এসব সমস্যা মোকাবিলায় রাজনৈতিক অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে নাগরিক সংগঠনগুলোরও কাজ করা উচিত।
ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, ইএসডিও, ঠাকুরগাঁও বলেন যে, স্থানীয়করণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতিমালার প্রয়োজন। নাগরিক সংগঠনগুলোকে শুধু আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর না করে অর্থায়নের বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট, বাংলাদেশ উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু উন্নতি হচ্ছে কি? উন্নতি হলো জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন। তিনি গণতান্ত্রিক চর্চার অপর্যাপ্ততা, সুশাসনের ব্যর্থতা, প্রশাসনের স্বচ্ছতার অভাব ইত্যাদি বিষয়কে উন্নতির পথে অন্তরায় বলে মনে করেন।
ড. দেবপ্রিয় তার বক্তব্যের শেষে সকলকে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ ব্যক্ত করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, নাগরিকদের ভূমিকাকে নিশ্চিত করতে সরকারকে পূর্ণাঙ্গ কৌশলপত্র তৈরি করতে হবে। এছাড়াও জাতীয় নীতিমালার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমনঃ প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, দলিত ইত্যাদি সমাজের নাগরিকদের প্রাধান্য দিতে হবে। সবশেষে তিনি বলেন যে, নাগরিক সংগঠনগুলোকেও বৈদেশিক অনুদানের উপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প অর্থায়নের দিকে নজর দিতে হবে।
সংলাপের শেষে উন্মুক্ত আলোচনায় দর্শকমন্ডলীর নিকট থেকেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। কেউ কেউ বলেছেন প্রতিবন্ধী, দলিত এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জাতীয় নীতিমালায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আরো মনযোগ দিতে হবে। এছাড়াও বেসরকারি এবং নাগরিক সংগঠনগুলোতে আরো বেশি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলদেশের বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সংগঠন (সিএসও), নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী, সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং গণমাধ্যম কর্মীরাও এই সংলাপে অংশগ্রহণ করেন।
Leave A Comment