Originally published in Banikbarta on 3 December 2020
কভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, সহিংসতার মতো ঘটনা বাড়ছে। কভিড নারীদের নতুন কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে?
কভিড নারীদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। কোনো সংকটে সাধারণ মানুষের তুলনায় নারীরা সবসময় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। নারীদের জন্য বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নারীরা দেশের শ্রমবাজারে ক্রমান্বয়ে বেশি হারে অংশগ্রহণ করছেন। তবে তা অনানুষ্ঠানিক খাতে, অর্থাৎ যে কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই, নিয়োগপত্র নেই। যেগুলো দৈনিক মজুরি কিংবা সাপ্তাহিক মজুরির ভিত্তিতে চলে, এ কাজগুলোর পাশাপাশি নিম্ন আয়ের কাজগুলো তারা করে থাকেন। সংকটের সময় যখন কোনো পরিবার কিংবা প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়ে তখন প্রথমেই কিন্তু তারা নারীদের ছাঁটাই করে বা কাজ থেকে বের করে দেয়। এটি একটি অর্থনৈতিক সংকট। যেহেতু নারীদের আয়ের ওপর পরিবারগুলো নির্ভর করে, তাই তা পারিবারিক অর্থনৈতিক চাপও সৃষ্টি করে এবং সামাজিক পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি করে। ফলে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, সহিংসতার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া নারীদের আয়টা কমে যাওয়ার কারণে পরিবার থেকে এক ধরনের চাপ আসে এবং সে চাপটা অনেক সময় সহিংসতার আকার ধারণ করে। এরপর বাইরে যখন সমাজের বিভিন্ন জায়গায় তারা চলাফেরা করেন, তখনো এ ধরনের সহিংসতা বা নির্যাতনের বিষয় দেখা যায়। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, এ সংকটের সুযোগে নারীদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে। আগে থেকে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে কভিড আরো ঘনীভূত করেছে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ধর্ষক বা এর সঙ্গে জড়িতরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। নিপীড়িত নারী বা শিশুটি তুলনামূলক দরিদ্র বা অসহায় গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে শ্রেণীগত কোনো বিষয় রয়েছে কি?
এখানে অবশ্যই শ্রেণীগত বিষয় রয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, যেকোনো সমাজেই প্রভাবশালী, উচ্চবিত্ত ও বিত্তহীনদের মধ্যে শ্রেণীগত বৈষম্য নির্ধারণ করে যে তাদের মধ্যে সম্পর্কটা কী হবে। এদের সঙ্গে সামাজিক সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বা সামাজিক সংযোগটা কেমন হবে। সে কারণে দেখা যায় নিপীড়িত নারীদের বেশির ভাগই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর, এখানে নিম্নবিত্ত নারীরাও রয়েছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যারা প্রভাবশালী নন, তারাই বেশি এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগটা অনেক বেশি, কারণ সমাজে যে শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টি হয়, সেটা নির্ধারণ করে দেয় কে কোথায় থাকবে এবং কার প্রতি কী ধরনের আচরণ করা হবে। নারীরা তুলনামূলকভাবে যেহেতু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, তাই নারীর ওপর বা তার পরিবারের ওপর বিরূপ মনোভাব হলে তাকে লক্ষ্য করে অত্যাচার করা হয়। আবার কোনো নারী যদি প্রতিবাদ করেন—কর্মক্ষেত্রে বা সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে—তখন শারীরিকভাবে তার সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে তারা নারীদের শিক্ষা দিতে চায়। তারা মনে করে, এভাবে তারা নারীর প্রতিবাদের ভাষা ও ইচ্ছাকে অবদমন করতে পারে। বছরের পর বছর এত প্রতিবাদ হওয়ার পরও কেন এটা চলছে? কারণ যারা ধর্ষক কিংবা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত, তাদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক যোগাযোগ হয়ে যায় এবং তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলে যায়। যেহেতু আমাদের সমাজে শ্রেণীগত বৈষম্য রয়েছে, সুতরাং আচরণটা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আবার অর্থহীন দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত নারীর প্রতি একজন উচ্চবিত্ত নারীর আচারণেও কিন্তু এক ধরনের বৈষম্য থাকে। পত্রপত্রিকায় এ ধরনের খবর কিন্তু মাঝে মাঝেই আমরা দেখতে পাই। তেমনিভাবে আবার অসহায় ও গরিব শিশুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা ঘটছে, অনেক সময় জনসমক্ষে অত্যাচার করা হচ্ছে, এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। এক্ষেত্রেও যারা অত্যাচার করছে, তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। সুতরাং সামগ্রিক বিষয়টা নিয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনার করার বিষয় রয়েছে।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, যেকোনো অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডকে কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশ মানবাধিকারের লঙ্ঘন বা নির্দয় বিষয় হিসেবে মনে করছে, যা একেক দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখানে কয়েকটি বিষয় রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে একমুখী কোনো পদক্ষেপের মাধ্যমে বেড়ে চলা অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করা যাবে না। আমাদের দেশে অনেক অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রয়েছে, কিন্তু সে অপরাধগুলো কি বন্ধ হচ্ছে? হচ্ছে না। কাজেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করলেই যে অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে, এ ধরনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের দেখতে হবে আইন কীভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। যারা অপরাধ করছে, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো যদি আমরা চিহ্নিত না করি, তাহলে এ সংস্কৃতি বন্ধ হবে না। তাছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে কী ধরনের মূল্যবোধ শেখানো হচ্ছে এবং নারীদের কীভাবে দেখানো হচ্ছে, সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ কীভাবে গড়ে উঠছে, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি হচ্ছে কিনা, নাকি অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে এবং রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে তাদের পার পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। এগুলোকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি না দেখা হয় তাহলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন করা হোক না কেন, তাতে এগুলো বন্ধ হবে না। আর মূল্যবোধের অবক্ষয় তো সর্বত্র হচ্ছে। সেটা শুধু নারী নয়, দুর্বলের প্রতি অত্যাচার বেড়েছে। তাছাড়া সহায়-সম্পত্তিহীন, দরিদ্র, কৃষক কিংবা রিকশাওয়ালা, তাদের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করা হয়, তারা তার বিচার পান না বা আদালতের দোরগোড়ায়ও যেতে পারেন না। তাই আমরা যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করি, তাহলে কোনো ধরনের অপরাধই বন্ধ করা যাবে না।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সঙ্গে কি নারী নির্যাতনের কোনো সম্পর্ক রয়েছে? আমাদের সমাজের নৈতিক অধপতন ত্বরান্বিত হয়েছে, নাকি মিডিয়ার কল্যাণে আগে যেসব খবর সামনে আসত না, এখন তা আসছে।
প্রথম প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রে আমি বলব, হ্যাঁ, কিছুটা সম্পর্ক আছে। কারণ অর্থনৈতিক অবস্থাই নির্ধারণ করে একজন নারীর অবস্থানটা কেমন হবে। তার সঙ্গে পরিবারের অন্যদের সম্পর্কটা কী হবে। তার সঙ্গে সমাজের অন্যদের সম্পর্কটা কী হবে। শুধু সমাজের উচ্চপর্যায়ের নারী নন, বিভিন্ন শিল্প যেমন তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের কারণে পরিবারে তাদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সমাজে নারীর অবস্থানের উন্নতি হচ্ছে না। নারী যখন রাস্তায় বের হন বা বাসে করে কারখানায় যান, তখন যেকোনো পুরুষই তার প্রতি নির্যাতনমূলক আচরণ করতে পারেন। নারীর অর্থনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে যা সম্পর্কিত নয়। এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন এবং সমাজের সামগ্রিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। পরিবারের ভেতরে হয়তো সম্মান পাচ্ছেন, তবে নিম্ন আয়ের ও নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীদের ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি আমরা দেখছি না। প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের উত্তরে বলব, দুটো কারণ। অবশ্যই মিডিয়ার কল্যাণে আমরা অনেক বেশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খবর জানতে পারছি, পাশাপাশি প্রচণ্ডভাবে নৈতিক অধপতন ঘটেছে। আমাদের শিক্ষা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো শোভন মূল্যবোধ ধারণ করে না। যার অর্থ আছে, সে অনেক বেশি ক্ষমতাবান। সে তার অর্থের প্রভাবের কারণে যেকোনো কিছুই করতে পারছে এবং পার পেয়ে যাচ্ছে। আইনের শাসনকেও তারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। ফলে নির্যাতিত ব্যক্তিটি তার অভিযোগটি করতে পারছেন না। আমরা প্রায়ই দেখি, ধর্ষণের শিকার হওয়া কোনো নারী বা তার পরিবার যখন অভিযোগ করতে যায়, সমাজের কোনো না কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে পুলিশ সে অভিযোগটি আর নিতে পারে না। সুতরাং আমি বলব, সামগ্রিক নৈতিক অবক্ষয়; যা কিনা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে জড়িত।
একেক জায়গায় (উপকূলীয়/পাহাড়ি/উত্তরবঙ্গে) নারীর অবস্থা একেক রকম। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি ও অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এসব জায়গায় কীভাবে সুযোগ তৈরি করা যায়?
একই ধরনের নীতিমালা বা পদক্ষেপ দিয়ে সবার জন্য একই রকমের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা যায় না। একেক জায়গার অবস্থা একেক রকম। উপকূলীয় এলাকাগুলো সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং যখন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় তখন নারী ও শিশু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরুষদের মতো খুব সহজে তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে যেতে পারেন না। তাছাড়া নারীপ্রধান পরিবারগুলোর জীবিকার ওপর যে আঘাতগুলো আসে, তা সামলে নিতেও অনেক সময় লাগে। এসব কারণে নারীদের ওপর এক ধরনের দ্বিমুখী চাপ আসে। আমরা জানি, পাহাড়ি এলাকায় অনেক নারীপ্রধান পরিবার রয়েছে। তারা পরিবারের অর্থনৈতিক দিকগুলো দেখে থাকেন। উত্তরবঙ্গে বৈশিষ্ট্য আবার ভিন্ন। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনায় উত্তরবঙ্গ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে। অন্যান্য জায়গার চেয়ে সেখানে বৈষম্য ও দারিদ্র্যের হারও বেশি। সেজন্য সেখানকার নারীদের ওপর চাপটা বেশি হয়। তাই এলাকাভেদে নারীদের জন্য উপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং প্রশিক্ষণ দিতে হবে; যা তাদের আয়বর্ধক কাজে সংযুক্ত করতে পারবে। পাশাপাশি যদি কেউ নিজের মতো করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা ছোট ব্যবসা শুরু করতে চান, সেক্ষেত্রে কিন্তু তাদের হাতে সেই পুঁজি বা মূলধন থাকে না। তাদেরকে পুঁজির সুযোগ করে দিতে হবে। সারা বাংলাদেশের জন্যই এটি প্রযোজ্য। বিশেষ করে এসব বিশেষ অঞ্চলের জন্য আরো বেশি করে প্রযোজ্য। দেখা যায় যে শহর কিংবা শহরের কাছাকাছি যেসব এলাকা রয়েছে, সেখানে যতটা সহজে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যায়, ওইসব জায়গায় কিন্তু অতটা সহজে যায় না। অনেক তথ্য তারা জানতেও পারে না। যেমন সিপিডির পক্ষ থেকে আমরা জরিপ চালিয়ে দেখেছি, কভিডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের সাহায্যের জন্য যে প্যাকেজের ঘোষণা করা হয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকেই কিন্তু এটি সম্পর্কে জানেনই না। ঋণের জন্য আবেদন করা তো দূরের কথা। এখানে তথ্যের প্রবাহটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে আরো বেশি তাদের কাছে পৌঁছতে হবে, তা না হলে তারা পিছিয়েই থাকবেন।
প্রান্তিক নারীরা দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করছেন। সেখানেও তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দক্ষতা ছাড়া বাইরে গিয়ে তারা যেমন বেশি আয়ের কাজগুলোয় অংশ নিতে পারেন না, তেমনি তাদের নিরাপত্তার জায়গাগুলো সুনির্দিষ্ট হয় না। এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু কোনো গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর পদক্ষেপ কেন নেয়া হচ্ছে না?
নির্যাতনের জন্য একটা সময় ওইসব দেশে নারীদের পাঠানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবে বন্ধ করে দেয়াটা সমাধান নয়, কারণ তাদের জীবিকার জন্য কাজ করতে হবে। দেশের ভেতরে বড় বড় শহরের পাশাপাশি দেশের বাইরে নারীদের কাজের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেসব জায়গায় কাজ করে পরিবারের জন্য তারা আয় করতে পারেন। শুধু নারী নন, দেশের বাইরে যে পুরুষরা কাজ করছেন, তারাও অনেক ক্ষেত্রে মানবেতর অবস্থায় কাজ করছেন। যে পরিমাণ বেতনের চুক্তি করা হয়, পরবর্তী সময়ে তারা তা পান না। যেভাবে তারা বসবাস করেন বা তাদের কাজের শর্তগুলোও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়মের মধ্যে পড়ে না। নারী যেহেতু দুর্বলতম, তাই এটি নারীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। তাছাড়া প্রবাসে আমাদের নারীরা শারীরিক পরিশ্রমসাধ্য কাজগুলো করেন। তাদের প্রতি যেকোনো ধরনের ব্যবহার, আচরণ করার বৈধতা রয়েছে—এ ধরনের একটি দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। যা নারীর নিরাপত্তার জন্য প্রচণ্ড আঘাতস্বরূপ। যে কারণে নারীরা এখনো তেমন বেশিসংখ্যক ওইসব দেশে যাচ্ছেন না বা যাওয়ার জন্য খুব একটা স্বস্তিবোধ করেন না। এটার জন্য অবশ্যই গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া যায়। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর নজরদারি রাখতে হবে। যারা যান তাদের তালিকা বা একটা ডাটাবেজ থাকতে হবে এবং তারা কী অবস্থায় আছেন, তার নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। বিভিন্ন সংস্থা অভিবাসী নারী ও পুরুষদের নিয়ে কাজ করছে। নজরদারি অনেক বেড়েছে। তার পরও সবাইকে নজরদারির মধ্যে আনা যাচ্ছে না। সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে অভিবাসীদের নিয়ে যে সংস্থাগুলো কাজ করছে এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে তাদের ওপর নজরদারি রাখতে হবে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষির বাইরেও আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। নারীরা যাতে সেই সুযোগগুলো পান, সে ব্যবস্থা করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায়?
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির বিবর্তন আমরা দেখছি। গ্রাম বলতে আমরা কৃষিই বোঝাতাম। কিন্তু কৃষির বাইরেও আমরা দেখছি যে বিভিন্ন ধরনের অকৃষিজাত (নন-ফার্ম) সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গত পাঁচ দশকে তো বটেই, বিশেষ করে গত দুই দশকে অনেক ধরনের বৈচিত্র্য এসেছে, বৈচিত্র্যময় কর্মকাণ্ড এবং সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। শহরে যে ধরনের কাজ সৃষ্টি হয়েছে, গ্রামেও সে ধরনের কিছু কাজ সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন রেস্তোরাঁ, সেলুন, ফটোকপির দোকান, সাইবার ক্যাফেসহ আরো এ ধরনের উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই। ঘরভিত্তিক কুটির শিল্পের বাইরেও বাজারে বিক্রির জন্য ছোট ছোট উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। এ কাজগুলোয় নারীদের অংশগ্রহণ করার অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিছু কাজের জন্য কোনো ধরনের শিক্ষার প্রয়োজন হয় না, দক্ষতা ও শারীরিক পরিশ্রমের ভিত্তিতে করা যায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্রামে কিংবা গ্রামের আশেপাশে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তবে খুব বেশি দূরে হলে নারীদের সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে যেতে অসুবিধা হয়। প্রশিক্ষণ ও অর্থ দুটোই লাগে। কভিডের আগেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যক্তি খাতের ব্যাংক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে কয়েকটি অসুবিধা বিদ্যমান। প্রথমত, তথ্য ঘাটতি। দ্বিতীয়ত, কীভাবে ঋণের জন্য আবেদন করবেন, সেটা তারা জানেন না। তৃতীয়ত, আবেদনের পর যখন দেখা যায় ব্যাংকের সঙ্গে তার লেনদেনের রেকর্ড নেই, তখন ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ দিতে উৎসাহিত হয় না। চতুর্থত, ব্যাংক ঋণ দিতে রাজি হওয়ার বিপরীতে গ্যারান্টি চায়। দরিদ্র নারীদের জন্য যা সম্ভব হয় না। তাছাড়া নারীরা যদি কিছু করতে চান, পরিবারেরও আস্থার অভাব থাকে। আস্থার অভাবটা নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। বেশির ভাগ নারীই দেখা যায় অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। আবার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে যে নারী কাজ শুরু করেছেন, তিনি হয়তো ট্রেড লাইসেন্স করেননি বা তার টিন নম্বর নেই। এসব কারণেও নারীরা ঋণ নিতে পারেন না। নারীদের আনুষ্ঠানিক ব্যবসার মধ্যে আসতে হবে। তাহলে তারা সুযোগগুলো নিতে পারবেন।
কভিড-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নারীবান্ধব বিনিয়োগে কী ধরনের নীতিগত পদক্ষেপের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে?
একটা হচ্ছে তাদের কাজের সুযোগের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। আরেকটি হচ্ছে, যারা উদ্যোক্তা হবেন না, তারা কিন্তু শ্রমবাজারেই যাবেন, তাদের শ্রমবাজারে উপযুক্ত করতে প্রস্তুতি নিতে হবে। কভিডের কারণে অনেক কাজই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে। কভিড-পরবর্তী সময়েও কিন্তু আমাদের এ প্রযুক্তিনির্ভরতা রয়ে যাবে। ফলে অনেক কাজের চাহিদা কমে যাবে। যারা প্রশিক্ষিত ও যাদের প্রযুক্তিজ্ঞান আছে, তারাই কাজগুলো পাবেন। এ মুহূর্তে নারীদের ওপর বিনিয়োগ করতে হলে আমি বলব, নারীদের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর বিনিয়োগ করতে হবে। তা না হলে শ্রমবাজারে নারীর যে ৩৫ থেকে ৩৬ শতাংশ অংশগ্রহণ রয়েছে, তা কমে যাবে। কারণ অনেক কাজই প্রযুক্তি নিয়ে নেবে। সেক্রেটারিয়াল কাজ, মেডিকেল রিপোর্ট লেখার কাজ, ফাইন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিং-সংক্রান্ত কিছু কাজের জন্য মানুষের আর দরকার হবে না। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ কম। সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথমেটিকস আগামী দিনের কর্মসংস্থানের জায়গাগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। এখানে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। দেখা যায়, মেয়ে মানে তারা আর্টস বা সামাজিক বিজ্ঞান পড়বে। এগুলোর প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যেসব কাজ সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত এবং অর্থনৈতিক মূল্য বেশি, নারীদের সেসব কাজে আসতে হবে।
কভিড পরিস্থিতিতে নতুন করে যে চ্যালেঞ্জগুলো তৈরি হয়েছে, যেমন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বাল্যবিবাহ বাড়ছে। ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
খুবই একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। কারণ এরই মধ্যে গণমাধ্যমেও বিষয়টি আমরা দেখতে পারছি। বাল্যবিবাহ বাড়ছে, কারণ গ্রামের স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে আছে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, তারাই কিন্তু কভিডের এ সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারছে। কিন্তু গ্রাম, প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা জেলা শহরের সব জায়গায় প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ নেই। প্রযুক্তিতে সবার অংশগ্রহণ নেই। স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে আছে। স্কুল বন্ধ থাকার সময়ে ছেলে শিশুদের মা-বাবা হয়তো কোনো কাজের জন্য পাঠাচ্ছে, কিন্তু মেয়েরা ঘরে বসে রয়েছে এবং মা-বাবা মনে করছে তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়া এখন সবচেয়ে নিরাপদ। এতে অর্থনৈতিক চাপ কমার পাশাপাশি মেয়েসন্তানের নিরাপত্তা নিয়েও তারা বাড়তি চাপমুক্ত হচ্ছেন। এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাত রয়েছে। সামাজিক অভিঘাত হচ্ছে, কম বয়সে মা হওয়ার কারণে তাদের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সময় যেসব সূচকে ভালো করেছিল, তার মধ্যে ছিল শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর বিষয়গুলো। শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গ পার্থক্য কমানো হয়েছিল, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল, তা থেকে আমরা এখন পেছনের দিকে চলে যাব। কভিড পরিস্থিতিতে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে তারা কম বয়সে সন্তান ধারণ করবেন, তাদের স্বাস্থ্য ও সন্তানের স্বাস্থ্যের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে তারা শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবেন এবং শ্রমবাজারেও আর অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আমরা দেখছিলাম, সেটার ওপরও একটা অভিঘাত আসবে।
অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়ছে, কিন্তু নারীদের মজুরিবৈষম্য, কাজের অনিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রে নিপীড়ন কমছে না। এর বিপরীতে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন?
বিষয়টি খুবই দুঃখজনক যে অর্থনীতিতে নারীর অবদান, অংশগ্রহণ বাড়ছে, কিন্তু তার পরও মজুরিবৈষম্য কমছে না। তাছাড়া মজুরিবৈষম্য যে শুধু নিম্ন আয়ের নারীদের মধ্যে রয়েছে তা নয়, উপরের দিকেও রয়েছে। তাছাড়া এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, সারা বিশ্বেই নারী ও পুরুষের মধ্যে আয়বৈষম্যের প্রবণতা দৃশ্যমান। আমরা যাকে ‘হোয়াইট কালার জব’ বলি, সেসব কাজেও এ বৈষম্য রয়ে যায়। তবে যে নারীরা নিম্ন আয়ের কাজগুলো করে থাকেন, আমরা যাকে বলি কম দক্ষ কাজ, সেখানে তো অবশ্যই থাকে। নিম্ন আয়ের কাজ, যেমন নির্মাণ শ্রমিক, পোশাক শ্রমিক, চা শ্রমিক, তামাক শ্রমিক—এ ধরনের যে কাজগুলো রয়েছে, সেখানে নারী ও পুরুষের অনেকখানি মজুরিবৈষম্য বিদ্যমান। এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। কারণ মনে করা হয়, নারীরা কম পরিশ্রমী। বিশেষ করে নারী যখন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, তখন হয়তো বলা হয় তারা কমসংখ্যক ইট বা বোঝা নিতে পারেন বলে তাদের কম মজুরি দেয়া হবে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়গুলো বন্ধ না হলে মজুরিবৈষম্য থাকবে। শুরুর দিকে আমরা যেমনটা আলোচনা করছিলাম, দৃষ্টিভঙ্গির এ বিষয়টা কিন্তু আমাদের সামগ্রিক সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে জড়িত। মজুরিবৈষম্যের আরো একটি কারণ হচ্ছে নারীরা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন। অনানুষ্ঠানিক খাতে তাদের অংশগ্রহণ কমিয়ে যদি আনুষ্ঠানিক খাতে নিতে না পারি তাহলে মজুরিবৈষম্য রয়েই যাবে। এই নারীদের আরো বেশি শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করা দরকার। তাহলে মজুরিবৈষম্যের পাশাপাশি কাজের অনিশ্চয়তা ও নিপীড়নের বিষয়গুলো হ্রাস করা সম্ভব হবে। ৯০ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, তাদের সবাইকে আনুষ্ঠানিক খাতে নেয়া সময়ের ব্যাপার। তবে কি তারা এ অনিশ্চয়তার মধ্যেই থাকবেন? না। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীদের কিন্তু সম্মিলিত ভয়েস নেই। তাই নারী অধিকার সংগঠন, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। বৈষম্য দূর করার জন্য কাজ করতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে। বৈষম্য বন্ধের দাবি তুলতে হবে।
ঘরে নারীরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। নারীর মজুরিবিহীন বা অর্থনৈতিক স্বীকৃতিহীন কাজের আর্থিক মূল্য কি নিরূপণ করা সম্ভব? এই যে নারীর কাজের আর্থিক মূল্য চিহ্নিত হচ্ছে না বা স্বীকৃতি পাচ্ছে না, এর সঙ্গে তো নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের বিষয়টিও জড়িত।
বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা নিয়ে আমরা অনেক দিন থেকেই কাজ করছি। নারীরা বাইরে গিয়ে অর্থ উপার্জন করেন এবং ঘরেও কাজ করেন। ঘরের কাজগুলো কোনো অংশেই বাইরের কাজের চেয়ে কম নয়। আবার যারা বাইরে কাজ করেন, তারা আবার ঘরেও কাজ করছেন—তাদের ওপর দ্বৈত চাপ থাকে। আবার যে নারীরা পারিবারিক দায়িত্বের কারণে বাইরে কাজ করতে পারছেন না, তাদের ওপর পরিবারের সামগ্রিক কাজের দায়িত্ব থাকে। সকাল থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত পরিবারের যতগুলো কাজ রয়েছে, তারা তা পালন করেন। আবার যারা বাইরে কাজ করছেন না, শুধু ঘরের কাজ করেন, তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে তুমি তো কিছু করো না। বিষয়টা এমন যেন কিছু করে অর্থ উপার্জন করা। যেহেতু ওই নারী অর্থ উপার্জন করেন না, তাই পরিবারে তিনি মূল্য পান না। আবার বাইরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের পারিবারিক কাজের স্বীকৃতি দেয়া হয় না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা উৎপাদনে আমাদের প্রথাগত যে হিসাব—মোট দেশজ উৎপাদন—এর মধ্যে নারীর গৃহস্থালি কাজের প্রতিফলন নেই। কারণ কোনো কাজ বা সেবার বিনিময়ে অর্থ পেলে তা জিডিপি হিসাবের মধ্যে ঢুকবে। জিডিপি হচ্ছে এক বছরে কী পরিমাণ পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়েছে এবং এর বিনিময়ে কী পরিমাণ অর্থ উপার্জিত হলো। সেজন্যই নারীদের গৃহস্থালি কাজগুলো জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। আমাদের মায়েরা ঘরে যে খাবারটা তৈরি করেন, ওটা যদি আমরা বাইরে গিয়ে খাই তাহলে কিন্তু টাকা দিয়ে খেতে হবে বা তারা যদি খাবারটা বিক্রি করেন তাহলেও এর বিনিময়ে তারা অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। একইভাবে নারীর মর্যাদার বিষয়টিও এখানে জড়িত। ছোট শিশুদেরও যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে তোমার মা কী করেন? তার মা যদি গৃহিণী হন, তাহলে সে বলে, কিছুই করে না। আমার কাছে মনে হয়, প্রশ্নটিই সঠিক নয়। এখানে দৃষ্টিভঙ্গিরও বিষয় রয়েছে যে আমরা কী ধরনের প্রশ্ন তাদের করব। এর সঙ্গে পরিবারের মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের বিষয় রয়েছে। নারীরা তো রাতারাতি সবাই শ্রমবাজারের বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারবেন না। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এমন অবস্থায় পৌঁছেনি যে নারীরা তাদের সন্তানদের নিরাপদে দিবাযত্ন কেন্দ্রে রেখে কাজ করতে পারবেন। এটা আমরা এখনো দেখছি না। আবার অনেক নারীর থাকার জায়গা নেই, তারা শহরে এসে কোথায় থাকবেন, যথেষ্ট পরিমাণে হোস্টেল গড়ে ওঠেনি। যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা পুরোপুরিভাবে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মর্যাদাহীন অবস্থায় থাকবেন। তাই তারা যাতে মর্যাদাহীন অবস্থায় না থাকেন, সেজন্যই আমরা বলছি এ কাজগুলোর স্বীকৃতি দিতে হবে। তারা যদি এ কাজগুলো না করতেন তাহলে পরিবারের অন্য সদস্যরা যারা বাইরে কাজ করছেন বা সন্তান যারা বাইরে পড়াশোনা করছে, এগুলো সম্ভব হতো না। নারীরা ঘরে থেকে তাদের জন্য সেবা তৈরি করছেন, বয়স্কদের দেখাশোনা করছেন—এগুলো অন্য একজনকে দিয়ে করতে হলে বেতন দিতে হতো। নারীরা এটা লেবার ফর লাভ বা ভালোবাসার বিনিময়ে করছেন। তাদের কাজগুলোর বিনিময়ে অর্থ দেয়া হয় না। এটা খুবই একটা অর্থপূর্ণ কাজ। অনেক দেশেই নারীদের কাজের জন্য জিডিপিতে এর প্রতিফলন ঘটানোর দাবি উঠেছে। জিডিপির কাঠামো তো বাংলাদেশের একার পক্ষে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, এটা আন্তর্জাতিকভাবে পরিবর্তিত হতে হবে। তবে যতক্ষণ না সেটা পরির্তিত হয়, ততক্ষণ একটা স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট করে নারীদের কাজের একটা হিসাব-নিকাশ করা হোক। টাইম-ইউজ সার্ভে করা হোক। অর্থাৎ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারীরা কী ধরনের কাজ করেন, সেটার বিপরীতে কী ধরনের অর্থনৈতিক মূল্য শোধ হতে পারে, এর একটা প্রতিফলন যাতে এ হিসাবে দেখানো হয়। তাহলে আমরা বলতে পারব, নারীরা যে কাজ করেন, সেটা জিডিপির এত অংশ। এটা জিডিপিতে যোগ করলে হয়তো জিডিপির আকার অনেক বেড়ে যাবে। এটা হয়তো প্রকৃত জিডিপি নয়, একটা ছায়া জিডিপি হবে। কিন্তু এটা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যাতে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টা বুঝতে পারি।
—ড. ফাহমিদা খাতুন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক। কাজ করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ইউএনডিপি ও ইউএসএআইডিতে। খণ্ডকালীন শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ ও গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পোস্টডক্টরেট করেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এসডিজি নিয়ে কাজ করেছেন। নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। দেশ-বিদেশে তার অসংখ্য গবেষণাপত্র ও বই প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী কর্মকাণ্ডেও জড়িত হয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অর্থনীতিবিদ প্যানেলের সদস্য। কভিড পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা ও অর্থনীতিতে এর প্রভাবসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুহিনা ফেরদৌস
ধর্ষণের বিচার চাই