Originally Published in সমকাল on 18 September 2020

করোনা: নতুন স্বাভাবিকতায় করণীয়

গত ৬ মাস বাংলাদেশ একটা অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই অতিমারি সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির শক্তির পাশাপাশি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। মার্চ মাসে অতিমারির প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারপ্রধানের পক্ষ থেকে দ্রুত কিছু নীতি প্রস্তাব আসে। সরকার সঠিকভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়, অর্থনীতির ক্ষেত্রে অতিমারির প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের ব্যয় বাড়াতে হবে, প্রণোদনা দিতে হবে, বাজারে তারল্য সঞ্চালন করতে হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বিস্তৃত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতেও কিছু উদ্যোগের কথা সেই সময়ে বলা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি, ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক কাঠামোগত জটিলতার ফলে প্রকৃত লক্ষ্যনির্দিষ্ট গোষ্ঠী বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা এবং প্রথাগতভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে এসব সহায়তা যথার্থ ও কার্যকরভাবে পৌঁছায়নি। স্বাস্থ্য খাতের তৎপরতায় সমন্বয় ও দক্ষতার অভাব স্পষ্ট  হয়ে ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে এই অতিমারি মোকাবিলার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে উদ্যোগ পরিচালিত হয়, যার প্রধান বাস্তবায়নকারী হিসেবে আসে প্রশাসন। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি, সামাজিক উদ্যোগ, ব্যক্তি খাত- এদের সামর্থ্য ও সম্ভাবনাকে যথোপযুক্তভাবে জাতীয় উদ্যোগে যুক্ত করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি। তবে এ সময়ে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের গরিব মানুষের টিকে থাকার সামর্থ্য এখনও অভূতপূর্ব। একই সঙ্গে মানবতার চেতনাও সমাজের ভেতর বহুলভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

এখন ছয় মাস পরে আমাদের দেখতে হবে, কোভিড-১৯ থেকে আমরা কী শিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছি এবং আগামী দিনে আমাদের কী করতে হবে। প্রথমে যেটা আমাদের মানতে হবে, দেশের ভেতরে প্রত্যেকেই এই বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য অবদান রাখছেন। সে ক্ষেত্রে দেশের এমন দুর্যোগে সবাইকে যুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো বিদ্যমান ত্রুটিকে নির্দিষ্ট করলে তাকে অস্বীকারের মনোভাব থেকে বেরিয়ে ইতিবাচক মনোভাব থেকে আমাদের চিন্তা করতে হবে। এটা একটা বড় শিক্ষা বলে আমাদের মনে হয়। অতিমারি যেমন অনেকভাবে পিছিয়ে দিয়েছে, একই সঙ্গে তা আমাদের অসম্পূর্ণতাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রকাশ করেছে। নেতৃত্বের দায়িত্ব হলো, এই অসম্পূর্ণতাকে অতিক্রম করার জন্য সমন্বিত কর্মসূচি দিয়ে সবাইকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। সুতরাং বর্তমানের এই দুর্যোগকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।

অতিমারির প্রভাব নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে কর্মসংস্থানের বিষয়টি। অতিমারির কারণে বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে আমরা চার বছর পিছিয়ে গেছি। তাহলে আগামী সময়কালে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমরা কীভাবে অতিমারির আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে পারব, তার জন্য একটা পরিকল্পনা দরকার। এই পরিকল্পনা দুই থেকে তিন বছর হতে পারে। এটি আগামী অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোষ্ঠীর যেসব চাহিদা প্রকাশ পাচ্ছে, সেগুলোকে এই পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর ভেতরে যেমন রয়েছে সদ্য শ্রমবাজারে আসা তরুণ সমাজ, তেমনি তার সঙ্গে রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে পুঁজি হারানো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, বন্ধ হয়ে যাওয়া সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানের বহু কর্মচারী-কর্মকর্তা ও শ্রমিক, বিদেশ থেকে ফিরে আসা অনাবাসী শ্রমিক এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গ। তাদের সঙ্গে রয়েছে গত ১০ বছরে বেড়ে ওঠা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা হঠাৎ করে একটি বিপন্ন অবস্থার মধ্যে ঢুকে গেছে। এই মানুষকে চিন্তা করে অবশ্যই একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে যার প্রথম অংশ হবে তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা। এই পরিকল্পনা শুধু শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দিয়ে করা সম্ভব নয়। আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। এটি একটি বড় জায়গা বলে আমার কাছে মনে হয়।

হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জিডিপির ২ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের জন্য ১ শতাংশ যায়। বাকি ১ শতাংশ ব্যয় হয় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর ভাতা হিসেবে। সুতরাং দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অর্থ বরাদ্দ এবং মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিরাপত্তা বলয়কে এখন সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোতে নিয়ে যেতে হবে, যাতে এটা সর্বজনীন রূপ নিতে পারে। এখন এ ক্ষেত্রে প্রথমে যেটা দরকার শিক্ষা খাতে মাধ্যমিক পর্যায়কে এর অধীনে আনতে হবে অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের ভাতা দিতে হবে। আমাদের অদক্ষ নারীদের আরও দক্ষতা বাড়ানোর কর্মসূচি নিতে হবে। ভৌগোলিকভাবে বঞ্চিত এলাকাগুলোকে আরও বড়ভাবে এখানে আনতে হবে। আদিবাসীসহ পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি করে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে আনতে হবে।

অর্থনীতির পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে স্থবির হয়ে থাকা কর আদায় এবং ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে ম্রিয়মাণ পুঁজিবাজার সরকারের উচ্চাভিলাষী নীতি বাস্তবায়নে খুব বড় ভূমিকা রাখতে পারেনি। সুতরাং পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার কাঠামোর আওতায় আনতে হবে। সরকারকে কর আদায়ের ক্ষেত্রে নতুন ভ্যাট আইন প্রচলন ছাড়াও একটি বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিতে হবে যাতে বাংলাদেশের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে এমন সব মানুষ করের আওতায় আসে, যাতে করে যারা আগে থেকেই কর দেন, তাদের ওপর চাপ কমে। ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজারে একইভাবে সংস্কার করতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি, স্থানীয় সরকার এই অতিমারিকালে কার্যকর ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেনি। উপরন্তু সরকারকে শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করতে হয়েছে। এই সময়ে সরকার ২০০ কোটি ডলারের মতো বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এর সঠিক ব্যবহার হতে হবে।

সবশেষে মনে করি, আগামী দিনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকে, তাহলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে যে বিরূপ মনোভাব গড়ে উঠেছে, তা সামাজিক অসন্তোষে রূপ নেবে। এ কারণে সামাজিক জবাবদিহির ক্ষেত্র প্রশস্ত করতে হবে।

 

লেখক : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

অর্থনীতিবিদ, এসডিজি প্ল্যাটফর্মের আহবায়ক  এবং সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো