Originally published in The Daily Samakal on 25 November 2020

গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭১২ কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তা পেয়েছে। এর আগের অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ৬২০ কোটি ডলার। বলা যায়, করোনাকালে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে। কভিড-১৯ অতিমারির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অন্তত ৪০০ কোটি ডলারের নতুন বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির এক শতাংশের মতো।
অবশ্য সমজাতীয় অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বৈদেশিক অর্থপ্রবাহ কম। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে বৈদেশিক সহায়তা কম, যা জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ। বৈদেশিক অর্থপ্রবাহের জন্য রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বেশি। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) এক-তৃতীয়াংশের বেশি বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে অর্থায়ন করা হচ্ছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে।

বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তার দুই-তৃতীয়াংশ সাশ্রয়ী সুদহারের অর্থায়ন। নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে ইতোমধ্যে উত্তরণ এবং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকায় বাংলাদেশে সহজ শর্তের ও কম সুদের অর্থায়নের অংশ কমে আসার প্রবণতা রয়েছে। অন্যদিকে অনুদানের অংশও কমে যাচ্ছে। গত অর্থবছরে মোট বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে ঋণের অংশ ৯৬ শতাংশ এবং অনুদান ৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার প্রায় ৪০ শতাংশ এসেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো খাতে। বহুবিধ খাতে সংযুক্ত প্রকল্পে এসেছে প্রায় ৮ শতাংশ। মানবিক সহায়তা বিশেষত রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য এসেছে ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে রয়েছে, যা জিডিপির প্রায় ৩৮ শতাংশ। ঋণ পরিশোধের দায় মোট পণ্য ও সেবা রপ্তানি এবং প্রাথমিক আয়ের ৬ শতাংশের কিছুটা বেশি। তবে ২০১৫ সাল থেকে বৈদেশিক দায়দেনা পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ এখন ২৩২ ডলার, যা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

করোনা মোকাবিলার জন্য আসা বৈদেশিক সহায়তার প্রায় ৯০ শতাংশ এসেছে বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ফান্ড থেকে। দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে এসেছে ৮ শতাংশ। জাতিসংঘের ব্যবস্থায় এসেছে ২ শতাংশের বেশি। দ্বিপক্ষীয় তহবিলগুলোও জাতিসংঘের মাধ্যমে এসেছে। করোনা পরিস্থিতিতে আসা সহায়তার ৪৬ শতাংশ এসেছে বাজেট সহায়তা হিসেবে। আমাদের কর আদায় যেহেতু কম, সেহেতু বাজেট সহায়তা এ সময়ে বেশ উপকারে আসবে। সরকার এসব অর্থ স্বেচ্ছাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারবে।

কভিড মোকাবিলাকে মাথায় রেখে বিভিন্ন খাতভিত্তিক সহায়তার জন্য এসেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। জরুরি স্বাস্থ্য ও এ সম্পর্কিত অন্যান্য সহায়তার জন্য এসেছে ১৪ শতাংশের বেশি। কভিডকালে বহুপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক দিয়েছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি। এর পরের অবস্থানে রয়েছে আইএমএফ এবং এডিবি। আইএমএফ যে সহায়তা দিয়েছে, তার শতভাগ বাজেট সহায়তা। অন্যদিকে এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকের (এআইআইবি) ৭১ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাংকের ১৭ শতাংশের বেশি অর্থায়ন এসেছে বাজেট সহায়তা হিসেবে।

মোটা দাগে আগামীতে বাংলাদেশের সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো- করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলার অর্থায়ন, এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বিদেশি ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়া এবং এসডিজির অর্থায়নের ঘাটতি মেটানো। কভিড মোকাবিলা এবং অন্যান্য কারণে আগামী বছরগুলোতে বৈদেশিক অর্থায়নের বর্ধিত চাহিদা থাকবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বৈদেশিক সাহায্যপ্রবাহ ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি রেয়াতি সুদ ও অনুদানের মাধ্যমে আসবে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজেট ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক অর্থায়ন ক্রমান্বয়ে বাড়বে। ২০২৫ সালে এটি জিডিপির ২ শতাংশের বেশি এবং নিট বাজেট ঘাটতির ৪৭ শতাংশের মতো দাঁড়াবে। বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সহায়তা আসবে বলে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বৈদেশিক সম্পদ সংগ্রহের বিষয়ে বেশ উচ্চাভিলাষী। অবশ্য এই উচ্চাভিলাষ উন্নয়ন সহায়তা সংগ্রহের ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে দেখানো হয়েছে বলা যাবে না।

করোনাকালে বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রে চিন্তার মূল জায়গা হচ্ছে- সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণের কার্যকর ব্যবহার নিয়ে। অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার হলো কিনা, তা একসময় বিদেশিদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। বিশেষত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজির আমলে গরিব মানুষ ঠিকমতো অর্থ পেল কিনা তা একটি বড় চিন্তার জায়গা হয়ে দাঁড়াবে। পোশাক শ্রমিকদের সহায়তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে অর্থ দিচ্ছে, তা শ্রমিকরা ঠিকমতো পেল কিনা তার জবাবদিহি করতে হবে। সরকার অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য বৈদেশিক ঋণের অর্থ যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারে, তাহলে একদিকে ঋণের বোঝা বাড়বে, অন্যদিকে অর্থনীতির জন্য কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীকরণ অনুযায়ী নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের বিবেচনায় স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের পর্যায়ে রয়েছে। বড় ধরনের অপ্রত্যাশিত কিছু না ঘটলে আগামী ২০২৪ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হবে। বাংলাদেশের এই দ্বৈত উত্তরণের কারণে সামগ্রিকভাবে রেয়াতি অর্থায়ন কমে যাবে এবং যার ফলে বৈদেশিক ঋণের সুদহার বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। এই ক্ষতিপূরণে সহজ শর্তের ও কম সুদের ঋণের বিকল্প উৎসগুলো খুঁজতে হবে। যেহেতু ঋণের বোঝা বাড়ছে, সেহেতু কোন উৎস থেকে কোন খাতের কী জন্য টাকা নেওয়া হবে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের স্বচ্ছতা অত্যন্ত বড় বিষয়। এই প্রেক্ষাপটে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
এ সমস্ত কিছুর বিচারে উন্নয়ন সহযোগিতার জাতীয় নীতি দ্রুত হালনাগাদ করা জরুরি।

—দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অর্থনীতিবিদ; সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি