কক্সবাজার আইবিপি সড়কস্থ হরিজন পাড়া। ছবিটি তুলেছেন জনাব লোকমান হাকিম, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক কক্সবাজার।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস সহকারী নয়ন হরিজনের মতে, নতুন প্রজন্ম শিক্ষামুখী হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের জন্য অন্যান্য নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে না।

অজয়, গুনগুন ও টিটলী। হরিজন সম্প্রদায়ের এই তিন ভাইবোন উচ্চশিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরি করতে চায়। একই স্বপ্ন দেখে তুরামনি-তুর্জয়রাও। একজন হতে চায় চিকিৎসক, অন্যজন শিক্ষক। পরিচ্ছন্নকর্মী কাজল তার কন্যাকে বানাতে চান আইনজীবী। নবম শ্রেণী পড়ুয়া দুর্জয়ের স্বপ্ন হল সুন্দর পরিবেশ, একটি খেলার মাঠ।

এই স্বপ্নবোনা মুখগুলো হল কক্সবাজারে আইবিপি সড়কে বসবাসকারী হরিজন সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্ম। তাদের পিতা-মাতারা পৌরসভার পরিচ্ছন্নকর্মী। এতকাল তারা শিক্ষা বঞ্চিত ছিলেন, তবে অবশেষে সন্তানদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে পারছেন। বর্তমানে মহল্লাটির ১০০ মিটারের মধ্যে চারটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ৪০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

জেলা হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি ধনরঞ্জনের মতে, ১৮১৮ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের পূর্বপুরুষদের কক্সবাজারে এনেছিলো। সেই থেকে বংশ পরম্পরায় সেখানে তারা বাস করছেন। বর্তমানে ৩ একর ভূমিতে ১০০টি  পরিবার রয়েছে। ২০টি পরিবার একযুগ পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছে।

এদিকে শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চাও করছেন হরিজনেরা। তাদের সন্তানদের ‘স্মল আর্ট স্কুল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে নাচ, গান, কবিতা, চিত্রাংকন, আবৃত্তি শেখানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক রাজু বলেন, “মন্দিরের মেঝেতে প্রতিদিন প্রায় ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস নিই।  বর্তমানে মোট ২৫০ জন শিক্ষার্থী আছে।”

এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নীলা বলেন, “বাবা-মা চায় আমি পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, আবৃত্তি, গান শিখি।”

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস সহকারী নয়ন হরিজনের মতে, নতুন প্রজন্ম শিক্ষামুখী হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের জন্য অন্যান্য নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে না।

শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার অফিসের পরিচ্ছন্নকর্মী কলি হরিজন বলেন, “আমাদের সম্প্রদায়ের মেয়েদের  বাল্যবিবাহের প্রথাটি কমে গেছে। সন্তানদের সচেতন করছি, শিক্ষামুখী করছি।”

এদিকে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসর হলেও কর্মক্ষেত্রে ঘুচছে না বঞ্চনা। সেইসাথে জীর্ণ বাড়ি, সুপেয় পানি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, চাকুরি ও ভূমি হারানোর শঙ্কা কাজ করছে হরিজনদের।

পৌরসভার পরিচ্ছন্নকর্মী হরিজন সম্প্রদায়ের মোহনলাল বলেন, “সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত শহরের ময়লা পরিস্কার করি। কেউ সাধুবাদ জানায়, অনেকে কটুক্তি করে।” তার মতে, ১৫ বছর ধরে ৫ হাজার টাকা বেতনে তার জীবন বদলায়নি। অপরদিকে গোপালের ভাষ্য, “পৌরসভায় চাকুরির জন্য গেলে কেরানী টাকা খোঁজে।”

স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরির খোঁজে দুটি বেসরকারি হাসপাতালে আবেদন করা তরুণী কারিশমা বলেন, “সবাই মনে করে ‘হরিজন’ মানে খুবই নিচু জাতি।”

ইন্দারা হরিজন বলেন, “মহল্লায় ভূমি কম, বসতি বেশি। কেউ এলে থাকতে পারে না। একজন ঘুমালে বাকিরা জেগে থাকে। মোটর থেকে ছয়মাস পানি পাই, তাতেও প্রচুর আর্সেনিক।”

মিটুন হরিজন বলেন, “আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে আগে যারা যাতায়াত করতেন, ‘মেথর পাট্টি’ বলে কটুক্তি করতেন। রাস্তাটি উন্নত হওয়ায় এখন কেউ কটুক্তি করে না।”

হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি ধনরঞ্জন হরিজন বলেন, “অন্যান্য জেলায় ভুমির লীজ, আবাসনের ব্যবস্থা করা হলেও আমাদের শুন্য। বরং পৌর কর্তৃপক্ষের উচ্ছেদ আতংক বেশি ভাবাচ্ছে।”

যদিও পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, হরিজনদের ঘরগুলো উন্নত করে বাকী জায়গায় স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ করা হবে। মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, “বিষয়টি সমাধানে আমরা তাদের সাথে বসেছিলাম, আবারও বসব।”

কক্সবাজার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক প্রিয়তোষ শর্মা চন্দন হরিজনদের যেকোনো বিপদে পাশে থাাকার আশ্বাস দিয়ে বলেন, “আমরা তাদের পাশে ছিলাম, থাকব। ইতিমধ্যে মন্দিরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুদান দিয়েছি। শিক্ষার জন্য মন্দিরভিত্তিক গীতা স্কুল চালু করেছি।”

এ ব্যাপারে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “হরিজন-দলিতদের মুলশ্রোতধারায় সম্পৃক্ত না করলে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।”


এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ‘যুবদের জন্য উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ বিষয়ক একটি কর্মশালা গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালায় বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ থেকে ৩৭জন যুব সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার বিষয়বস্তু ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদেরকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা অথবা উন্নয়ন নিয়ে যুবদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন জনাব লোকমান হাকিম, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক কক্সবাজার।