Originally posted in সমকাল on 10 June 2022
করোনার মধ্যেও আগের দুটি অর্থবছরে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাগুলোতে যে ধরনের উচ্চাশা ছিল, এবারের বাজেট সে তুলনায় সংযত কিংবা অবদমিত। সরকারের আয় ও ব্যয় এবং সামগ্রিক বিনিয়োগ প্রাক্কলনের তুলনামূলক বিশ্নেষণে তেমনটাই মনে হচ্ছে।
আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৯ দশমিক ৭ শতাংশ রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে যা ছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে যা কমিয়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়েছে। সুতরাং আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্থনীতির আকারের বিবেচনায় কমানো হয়েছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল। সংশোধিত বাজেটে যা ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ ধরা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ।
একইভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়নি। জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা আগের চেয়ে কম। ব্যক্তি বিনিয়োগের প্রাক্কলনও আগের মতো। সরকারি বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত কয়েকটি অর্থবছরের চেয়ে কম। মোট বিনিয়োগ কম হবে অথচ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হবে। ফলে জিডিপি অনুমিতির সঠিকতা নিয়ে আগের সংশয় আরও জোরদার হলো।
অবশ্য অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে মেনে নিয়েছেন। তবে করোনার প্রভাব কেটে গেছে এরকম অতিশয়োক্তি আছে। আর বর্তমান সংকটের উৎসের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বিরূপ পরিস্থিতির ওপর পুরো দায় চাপিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ কারণের কথা সেভাবে উল্লেখ করেননি। আবার অর্থনীতির চলমান সমস্যার স্বীকৃতি থাকলেও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেই। বরাদ্দের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন নেই। আগের মতোই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের কম। শিক্ষা খাতে ২ শতাংশের কম। সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রেও তেমন পরিবর্তন নেই। ফলে অর্থমন্ত্রীর উপলব্ধির সঙ্গে কার্যক্রম মেলে না। আবার কার্যক্রমের সঙ্গে বরাদ্দের হিসাবও মেলে না।
এদিকে সরকারের ভর্তুকির বড় অংশ চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে। খাদ্য খাতে যা দেওয়া হচ্ছে, তার তিনগুণ নগদ সহায়তা যাচ্ছে পিডিবিতে। এর মধ্যে আইপিপির ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ কতটুকু, সেই তথ্য নেই। গরিব মানুষের জন্য সহায়তা না বাড়িয়ে এ ধরনের ভর্তুকি দেওয়া অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক নয়।
সমাপ্য বছরের সংশোধিত বাজেট বিশ্নেষণে দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে আয় বাড়ছে না, বরং ব্যয় বাড়ছে। এর ফলে উচ্চমাত্রার ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এত বড় ঘাটতি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কারণে হবে তা নয়। সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণেই তা হবে। ফলে বাজেটের ব্যয়বৃদ্ধি মূলত উন্নয়ন ব্যয়ের কারণে নয়।
বাজেট ঘাটতি মেটানোর দুটি উৎসের মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে দেশি উৎসের মধ্যে ব্যাংক থেকে আসবে ৪৪ শতাংশ। ব্যাংক থেকে এত টাকা নিলে তা ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে কিনা তাও চিন্তার বিষয়।
এবারের বাজেটে কর পদক্ষেপে সবচেয়ে অস্বস্তির জায়গা হলো- বিদেশে অর্জিত সম্পদ যা কিনা দেশ থেকে পাচার করা অর্থে সৃষ্ট, তাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যাপক কর রেয়াত দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে এরকম অনৈতিক সুবিধা দেওয়া অবশ্যই প্রশ্নের উদ্রেক করবে। বিশেষত প্রবাসীদের অবৈধ অর্থে সৃষ্ট সম্পদের বিষয়ে অনেক দেশ এখন খোঁজ-খবর নিচ্ছে।
অন্যদিকে করপোরেট কর কমানোর পদক্ষেপ ব্যবসায়ীদের খুশি করবে। তবে সীমিত আয়ের মানুষদের সুবিধা দিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব নেই। মূল্যস্ম্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। এ অবস্থায় করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বাড়ানো উচিত ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের এমন পদক্ষেপ কর ন্যায্যতার পরিপন্থি। অবশ্য করের ক্ষেত্রে কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ আছে। যেমন-প্রতিবন্ধীদের নিয়োগ দিলে কর ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে বাজেট প্রস্তাবে বড় ধরনের উদ্ভাবনী চিন্তা নেই। মূল্যস্ম্ফীতি বর্তমানের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে সমন্বিত কার্যকর পরিকল্পনা লক্ষ্য করছি না। যে সমস্ত বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তা মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যথোপযুক্ত ও যথেষ্ট নয়।
লেখক :সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি।