ছবিটি তুলেছেন জনাব লোকমান হাকিম, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক কক্সবাজার।

কক্সবাজার আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনথেন হ্লা রাখাইন বলেন, “আশির দশকের পর ৬০% রাখাইন জীবিকার খোঁজে পার্বত্য অঞ্চলে বসতি গড়ে। উন্নয়নের কবলে পড়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে কিছু পরিবার। এর মধ্যে ছোট মহেশখালীতে ৪০টি, খুরুশকুলে ৩০টি ও চৌফলদন্ডীতে ১০০টি পরিবার এখন উচ্ছেদ আতংকে রয়েছে।”

শতবছর পূর্বে কক্সবাজারে বসতি গড়া রাখাইনদের অনেকেই শামিল হয়েছেন বাঙালি মূল শ্রোতধারায়। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্য মনোনীত হওয়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখাইনরা আসিন হয়েছেন। তবে সময়ের ব্যবধানে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠী আবারও বাঙালি মূল শ্রোতধারায় ফিরতে সরকারের নানা স্বীকৃতি চায় ।

সরকার রাখাইনদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি’ স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ‘আদিবাসী’ পরিচয় বেশি পছন্দ তাদের। বিভিন্ন সংগঠনের নথি অনুযায়ী, আশির দশকের পূর্বে কক্সবাজারে রাখাইনদের আধিপত্য ছিল। বর্তমান বাঙালি শাসিত সমাজে তাদের ভাষা-সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে।

জনশুমারি ও গৃহগণনার সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজারে রাখাইন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। আদিবাসী ফোরামের তথ্যমতে, পাঁচ উপজেলার ১৪১টি গ্রামে ৯ হাজার ৫৭৫টি পরিবারের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশই ভূমিহীন।

বিভিন্ন উপজেলার ১৫ জন রাখাইন এবং তিনটি সংগঠনের প্রতিনিধির সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। রাখাইনরা বাঙালি শাসিত সমাজকে অনিরাপদ মনে করেন।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাজরীন-এ-জাকিয়া বলেন, “রাখাইনদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, সমাজ-সংস্কৃতির মৌলিকত্ব হারানোর শংকা, ভূমি দখলের ভয় কাজ করে। যার কারণে সর্বোপরি ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা তাদের ক্রমাগত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে।”

কক্সবাজার আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনথেন হ্লা রাখাইন বলেন, “আশির দশকের পর ৬০% রাখাইন জীবিকার খোঁজে পার্বত্য অঞ্চলে বসতি গড়ে। উন্নয়নের কবলে পড়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে কিছু পরিবার। এর মধ্যে ছোট মহেশখালীতে ৪০টি, খুরুশকুলে ৩০টি ও চৌফলদন্ডীতে ১০০টি পরিবার এখন উচ্ছেদ আতংকে রয়েছে।”

শুধু ভূমি নয়। এককালে রাখাইনদের আয়ের মাধ্যম ছিল নাপ্পী ব্যবসা। বেশ ক’বছর ধরে এ ব্যবসায় বাঙালিরাও ভাগ বসিয়েছে। শহরে রাখাইনদের দুটি শ্মশানের একটি বেদখলে। আরেকটিতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আপত্তিতে মামলা চলমান।

বুদ্ধিস্ট রাখাইন ওয়েলফেয়ার এসোসিশেয়নের সভাপতি মংছেন হ্লা বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে রাখাইন জেলেরাও এখন পেশা হারিয়েছে। স্বর্ণের দামের উর্ধ্বগতিতে কাজ কমে যাওয়ায়  হাজারেরও বেশি স্বর্ণকার পেশা বদলিয়েছে। পর্যাপ্ত কাঁচামাল সরবরাহ না থাকায় মহেশখালী-চকরিয়ার ৬টি তাঁত বুনন যন্ত্র ছাড়া বাকিগুলো বিলুপ্ত।”

সরকার ২০২০ সালে মহেশখালীকে শতভাগ বিদ্যুতায়িত উপজেলা ঘোষণা করলেও দ্বীপটির শাপলাপুর রাখাইনপাড়ার ২২টি পরিবার এখনো বিদ্যুতের আওতায় আসেনি। পরিবারগুলোর জীবিকার উৎস পান-সবজি চাষ। গ্রামটির দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী লামাচিং জানান, অনুন্নত জীবন-যাপনে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে।

ছোট বেলায় বৌদ্ধ বিহারের শ্রমণ ছিলেন চৌফলদন্ডীর অংছেন। তার ধর্মগুরু থেকে রাখাইন ভাষা রপ্ত করেছেন। এমন সুযোগ সবার হয় না। তরুণ অংছেনের মতে, নতুন প্রজন্ম নিজস্ব মাতৃভাষা লিখতে-পড়তে জানে না।

উসে মে, লাকি নু, হুই মে’সহ আড়াইশ’ তরুণী ৫-৭ হাজার টাকা বেতনে কক্সবাজার শহরের বার্মিজ মার্কেটে বিপণনকর্মীর চাকরি করেন। তরুণী লাকি নু’র অনুভব, মাতৃভাষা শেখার কোন প্রতিষ্ঠান থাকলে, তারও শেখার সুযোগ হতো।

আদিবাসী ফোরামের দাবি, নৃত্য প্রশিক্ষণসহ নানা সাংস্কৃতিক কমকান্ডে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য বছরে ৫০-৬০ লাখ টাকা সরকারি বরাদ্দ থাকে। কিন্তু সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পর্যন্ত সেই বরাদ্দ পৌঁছে না।।

নৃত্য সংগঠন আর কে’র প্রশিক্ষক ছেন ছেন ওয়ান বলেন, “আমার ৮ জনের সংগঠনকে মাঝে মধ্যে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও শিল্পকলা একাডেমিতে ডাকা হয়। তবে সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পাই না। ভয়ের কারণে তরুণীরা আগের মতো সাংস্কৃতিক চর্চা করে না।”

কক্সবাজারে রাখাইন, মারমা, তংচঙ্গা ও চাকমা সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত আদিবাসী ফোরাম নিজেদের অধিকার রক্ষায় গত ৯ আগস্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে ২২টি দাবি উত্থাপন করে।

দাবিগুলোর মধ্যে, আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা, আইএলও ১৬৯ সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করা এবং জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ কোটা বরাদ্দ রাখা অন্যতম।


এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ‘যুবদের জন্য উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ বিষয়ক একটি কর্মশালা গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালায় বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ থেকে ৩৭জন যুব সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার বিষয়বস্তু ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদেরকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা অথবা উন্নয়ন নিয়ে যুবদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন জনাব লোকমান হাকিম, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক কক্সবাজার।