ছবিটি তুলেছেন জনাব শাহরিয়ার শিমুল, নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক গৌড় বাংলা।

আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রাস্তা। বর্ষার সময় এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করা খুবই কষ্ট হয়। এমনকি বর্ষার সময় কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে রাস্তায় মারা যায়। তবে তার দাবি, যেহেতু এই গ্রামগুলো নাচোল উপজেলার মধ্যে পড়ে এবং তাদের সরকারি অফিস, হাসপাতাল নাচোলেই। সেহেতু বাসুগ্রাম দিয়ে রাওতাড়া হয়ে নাচোল পর্যন্ত রাস্তা পাকা করে দিলে এসব অঞ্চলের মানুষ চরম দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেত। 

কিংবদন্তি বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্রের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের পূণ্যভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের আদিবাসী অধ্যুষিত কয়েকটি গ্রাম কার্তিকপুর, বাসুগ্রাম, জমিনকমিন, লইলাপাড়া, ধরইল শ্যামপুর এই গ্রামগুলো ঘুরলে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা বাংলাদেশের মিল খুঁজে পাওয়া কিছুটা কঠিন। এই এলাকার মানুষদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে কৃষিকাজ। এইসব এলাকায় প্রায় শতাধিক পরিবারের বসবাস। 

গ্রামগুলোতে যাওয়ার জন্য নেই কোনো পাকা রাস্তা। হাল আমলে কয়েক কিলোমিটার হেরিংবোন বন্ড রাস্তা নির্মাণ হচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। গ্রামগুলোতে নেই কোনো বিদ্যালয়। সম্প্রতি বাসুগ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মিত হচ্ছে। যার বেশি সুবিধা পাবে বাসুগ্রামসহ পাশের কার্তিকপুর গ্রাম। অন্য গ্রামগুলোর জন্য বিদ্যালয়ের দূরত্ব কিছুটা দূর হবে বৈকি 

লইলাপাড়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য রয়েছে ২টি মিনি মোটর আর একটি টিউবওয়েল। কার্তিকপুর গ্রামে রয়েছে ২টি মোটার। এসব মোটর বা টিউবওয়েল নষ্ট হলে ঠিক করতে হয় নিজেদের পয়সায় এবং বিদ্যুৎ বিলও তারাই দেন। কার্তিকপুর, বাসুগ্রাম ও লইলাপাড়ায় রয়েছে ৩টি মুদি দোকান। এখানকার মানুষদের বাজার করার জন্য যেতে হয় প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার দূরে আমনুরা বাজারে। সেখানে যাওয়ার জন্যও নেই ভালো রাস্তা। কাঁচা পাকা রাস্তা ভেঙে যেতে হয় বাজার করতে। কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা সেবার জন্যও যেতে হয় সেখানে। এসব গ্রামে নেই কোনো ফার্মেসিও 

বাসুগ্রামের ৬১ বছর বয়সী জানু বলেন, আমার ৫ সন্তান সবাইকে গোদাগাড়ীতে আত্মীয়র বাড়িতে রেখে লেখাপড়া করিয়েছি। আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য বেশিদূর লেখাপড়া করাতে পারেননি বলে জানান তিনি। 

জানু বলেন, আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রাস্তা। বর্ষার সময় এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করা খুবই কষ্ট হয়। এমনকি বর্ষার সময় কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে রাস্তায় মারা যায়। তবে তার দাবি, যেহেতু এই গ্রামগুলো নাচোল উপজেলার মধ্যে পড়ে এবং তাদের সরকারি অফিস, হাসপাতাল নাচোলেই। সেহেতু বাসুগ্রাম দিয়ে রাওতাড়া হয়ে নাচোল পর্যন্ত রাস্তা পাকা করে দিলে এসব অঞ্চলের মানুষ চরম দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেত। 

লইলাপাড়ার মানতিন বলেন, আমাদের এখানে প্রায় ৩৫টি পরিবারের বসবাস। তিনিও বলেন, আমাদের রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। বর্ষার সময় যেতে পারি না। অন্য সময় প্রয়োজনে গেলে যাওয়ার জন্য কোনো গাড়ি পাওয়া যায় না। রাস্তা ভালো না হওয়ার জন্য এই দিকে কোনো গাড়িও আসতে চায় না সহজে। আমাদের যাতায়াতের মাধ্যম হচ্ছে ভ্যান বা নসিমন।  

তিনি জানান, আমাদের এখানে কিছু পরিবারকে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে একটি এনজিও সেমিপাকা টয়লেট দিয়েছে। এছাড়াও এই এলাকার বয়স্করা প্রায় সবাই বয়স্ক ভাতা পান বলে জানান মারতিন। 

একই এলাকার নবম শ্রেণিতে পড়ুয় আরবিয়াস বলেন, আমি আমার নানি বাড়ি ললিতনগর থেকে পড়ালেখা করছি। আমাদের এখানে কোনো প্রাইমারি, হাই স্কুল নেই। প্রাইমারি স্কুল আছে যেটা, সেটার দূরত্ব এখান থেকে ৪-৫ কিলোমিটার। 

জানা যায়, কার্তিকপুরে কারিতাসের একটি স্কুল ছিল। সেটিও অনেক দিন হলো বন্ধ হওয়া। তারপর থেকে কার্তিকপুর ও বাসুগ্রামের ছেলেমেয়েরা স্কুল যাওয়া থেকে বঞ্চিত। যেসব মা এক-আধটু লেখাপড়া জানেন, তারা তাদের সন্তানদের বর্ণমালা শেখান বাসায় বসে। আর যাদের সচ্ছলতা আছে, তাদের সন্তানরা অন্যত্র আত্মীয়র বাসায় থেকে লেখাপড়া করে।  

বাসুগ্রামে একটি কালীমন্দির আছে এবং সেখানে নিয়মিত ধর্মীয় আচার চর্চা হয় বলে জানান গ্রামবাসী।  

তবে সব কষ্ট ভুলে বাসুগ্রামবাসী আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন। কেননা এই গ্রামে নির্মিত হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাদের সন্তানরা অন্তত প্রাথমিক পর্যন্ত নির্বিঘ্নে লেখাপড়া করতে পারবে।  

জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর বাসুগ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ফেরদৌসী ইসলাম জেসি। এর নামকরণ করা হয়েছে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের নামের সাথে মিল রেখে “ইলা মিত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়”।  

বিদ্যালয়ের স্বপ্ন পূরণ হলেও এলাকাবাসীর দাবি, রাস্তাঘাট পাকাকরণের পাশাপাশি সপ্তাহে একদিনের জন্য হলেও স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা। তাদের আক্ষেপ ৪ থেকে ৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিয়মিত ভোট দিলেও এই গ্রামগুলোয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আসেন কালেভদ্রে। 

এদিকে এই কয়েকটি গ্রামের আদিবাসীদের সুবিধার্থে প্রত্যন্ত গ্রাম শ্যামপুর সন্যাসীতলায় সাপ্তাহিক হাট বসানোর উদ্যোগ নিয়েছেন আদিবাসী নেতা ও রানীমা ইলা মিত্র সংসদের সভাপতি বিধান সিং। হাটটি প্রতি শনিবার বসে। বিধান সিং জানান, হাটটি হওয়াতে কিছুটা কষ্ট লাঘব হয়েছে আশপাশের গ্রামের আদিবাসী জনগণের। তবে রাস্তা পাকা হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতো বলে জানান তিনি। 


এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ‘যুবদের জন্য উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ বিষয়ক একটি কর্মশালা গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালায় বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ থেকে ৩৭জন যুব সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার বিষয়বস্তু ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদেরকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা অথবা উন্নয়ন নিয়ে যুবদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন জনাব শাহরিয়ার শিমুল, নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক গৌড় বাংলা।