ছবিটি তুলেছেন মোঃ আব্দুল মান্নান, শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি, দৈনিক ইত্তেফাক।

“মৃৎশিল্পের কাজ এক সময় খুব কষ্টের ছিল। চৈত্র মাসে নদী থেকে মাটি তুলে রাখা হতো। এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন মাটি এনে আমাদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতি ট্রলি মাটির দাম পড়ে প্রায় ১ হাজার থেকে ১২’শ টাকা পর্যন্ত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই কাজ এখন অনেক সহজ হয়েছে। বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করে চাকা ঘুরিয়ে দই তৈরীর সরা, পাতিল, ও গ্লাস তৈরী করা হয়।”
– সুধাংশু কুমার পাল, মৃৎশিল্পী, সুঘাট ইউনিয়ন, বগুড়া

শীতের দুপুর। উঠান জুড়ে মিষ্টি রোদ। মাটি দিয়ে দইয়ের সরা বানিয়ে রোদে শুকানোর কাজ করছেন মমতা রানী (৪৫)। পাশেই মাটির তৈরী ছোট গ্লাসগুলো রোদে সারি সারি করে সাজিয়ে রাখেছেন  শ্রী শ্যামল চন্দ্র (৫০)। ক্যামেরার ক্লিক-ক্লিক শব্দে তাদের মনযোগে ছেদ পড়ে। বলে উঠেন, “ছবি তুলে কী হবে?” গত ২৫ জানুয়ারি বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের কল্যাণী পাল পাড়ায় (কুমার পাড়া) সরেজমিনে মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠি পাল (কুমার) সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক অবস্থা জানার জন্য গেলে এ ধরণের চিত্র দেখা যায়।

কল্যাণী গ্রামটি প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বাঙ্গালী নদী। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটিতে মূলতঃ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পাল বা কুমার সম্প্রদায়ে বসবাস। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হিটলারের দেয়া তথ্যমতে, কল্যাণী গ্রামে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ হাজার জন। এরমধ্যে হিন্দু ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩৫০ জন। এই গ্রামে ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি টেকনিক্যাল কলেজ, ১ টি মাদ্রাসা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ১টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।

এক সময় এই গ্রামে শিক্ষিত লোকের হার ছিল নগণ্য। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে  বেড়েছে শিক্ষার হার। আধুনিক জিনিসপত্রের ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ায় মাটির তৈরি পণ্যের ব্যবহার ভুলে মানুষ প্লাষ্টিক ও মেলামাইনসহ বিভিন্ন ধাতব দ্বারা তৈরি পণ্য ব্যাবহারে ঝুঁকে পড়লেও বগুড়ার ঐতিহ্য দইয়ের সরা-পাতিল ও গ্লাস তৈরী করে টিকে আছে এলাকার কামার বা পাল সম্প্রদায়ের মানুষ। এ কারণে এই  এলাকার মানুষ এখনো মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার ও তৈরী ভুলে যাননি।

শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি তারা আদি পেশা মৃৎ শিল্পকে ধরে রেখেছেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দেশের অন্যান্য এলাকায় মৃৎ শিল্পের বিলুপ্তি ঘটলেও কল্যাণী এলাকার চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। আধুনিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে তারা এখনো বংশ পরম্পরায় আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তাদের আদি পেশাকে।

শুধু তাই নয়, লাভজনক হওয়ায় হিন্দু ধর্মের লোকের পাশাপাশি মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরাও এ পেশাকে বেছে নিয়েছেন। মূলত তারা দইয়ের সরা, পাতিল এবং গ্লাস তৈরী করে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এই শিল্পের মাধ্যমে যেমনিভাবে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি দরিদ্রতাও দূর হয়েছে। মৃৎশিল্পকে আঁকড়ে রাখায় এই গ্রামে আর অতিদরিদ্র মানুষ নেই। এই শিল্প থেকে আয় করে সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে শিক্ষিত করে তুলেছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দই তৈরীর এসব উপকরণ তৈরীর অগ্রিম অর্ডার পান তারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত থাকেন কারিগররা।

দইয়ের সরা তৈরীর কারিগর মমতা রানী জানান, প্রতিদিন তিনি প্রায় ৩০০ সরা তৈরী করেন। প্রতিটি সরার জন্য তিনি এক টাকা হারে মজুরী পান। এই পেশায় তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যুক্ত। তাদের ২ ছেলে নীরব (১২) ও সন্দ্বীপ (৮) স্থানীয় স্কুলে ৬ষ্ঠ ও ৩য় শ্রেণিতে পড়াশুনা করে। ১ মেয়ে নিপা রানী-কে (২০) ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে  বিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানান, এই পেশায় নিযুক্ত থেকে পরিবারের যেমন দরিদ্রতা দূর করেছেন তেমনি সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রী শ্যামল চান্দ্র পাল জানান, তার ভাটায় প্রায় ৩০ জন কর্মচারী কাজ করেন। প্রতি এক মাস পর পর ভাটা জ্বালানো হয়। একটি ভাটায় ৫ হাজার সরা ও ২০ হাজার গ্লাস তৈরী করা যায়। প্রতি পিস সরা ৭/৮ টাকা, প্রতি পিস গ্লাস দেড়-দুই টাকায় বিক্রি হয়। তিনি জানান, এ পেশা থেকে আয় করে তার তিন ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তারা এখন বিভিন্ন সরকারি  বেসরকারি সংস্থায় চাকুরি করছেন।

কথা হয় এই গ্রামের একজন মৃৎশিল্পী সুধাংশু কুমার পাল-এর সাথে। তিনি কল্যাণী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি এই শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের কাজ এক সময় খুব কষ্টের ছিল। চৈত্র মাসে নদী থেকে মাটি তুলে রাখা হতো। এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন মাটি এনে আমাদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতি ট্রলি মাটির দাম পড়ে প্রায় ১ হাজার থেকে ১২’শ টাকা পর্যন্ত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই কাজ এখন অনেক সহজ হয়েছে। বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করে চাকা ঘুরিয়ে দই তৈরীর সরা, পাতিল, ও গ্লাস তৈরী করা হয়। অবসর সময়ে বসে না থেকে তিনি এই কাজ করে মাসে প্রায় ১৫/২০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করেন। কল্যানী গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হুমায়ুন কবির বিপ্লব জানান, লাভজনক হওয়ায় মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এ পেশাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। এরকম একজন মাসুদ। তিনি সোনালী ব্যাংকে চাকুরি করার পাশাপাশি প্রায় ১ একর জমির উপর সরা-গ্লাস তৈরীর একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাসুদ জানান, তার কারখানায় প্রায় ৩০ জন শ্রমিক/কারিগর কাজ করছেন।

সুঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান জিন্নাহ্ জানান, কল্যাণী পাল পাড়ার মৃৎশিল্প এই এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দরিদ্রতা দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও অবদান রাখছে। এ কারণে, উপজেলা সদর থেকে কল্যাণী পর্যন্ত রাস্তা পাকাকরণসহ সরকারি নানা সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন জিহাদী জানান, কল্যাণী গ্রামের পাল সম্প্রদায় এখনো দইয়ের সরা-পাতিল ও গ্লাস তেরী করে তাদের মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন। তাদের উৎপাদিত পণ্য সহজে পরিবহণের জন্য উপজেলা সদর পর্যন্ত রাস্তা পাকা করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া তাদের অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ঐ এলাকায় কাজ করছে।

___

‘যুবদের জন্য উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ বিষয়ক একটি কর্মশালা গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। এই কর্মশালায় বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ থেকে ৩৭জন যুব সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার বিষয়বস্তু ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদেরকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা অথবা উন্নয়ন নিয়ে যুবদের চাহিদাও প্রত্যাশা সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন জনাব মোঃ আব্দুল মান্নান, শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি, দৈনিক ইত্তেফাক।