Published in প্রথম আলো on Friday, 15 September 2017
প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠক
তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে আইন চাই
সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শুধু স্বীকৃতি দিলেই হবে না, তা বাস্তবায়নে নীতি ও আইন প্রণয়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব, তার পরিবর্তন ঘটাও জরুরি।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি: প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এ কথা বলেছেন। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ও সেভ দ্য চিলড্রেনের সহায়তায় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠকের শুরুতেই দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠী কেমন আছে, তা নিয়ে একটি ভিডিও দেখানো হয়।
আলোচনায় অংশ নেন হিজড়া তানিশা ইয়াসমিন চৈতি। পরিবারের দেওয়া নাম ছিল মামুন। চৈতি বলেন, ‘আমার নাম মামুন। কিন্তু আমি তো চৈতির মতো হতে চাই। মামুন নাম বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। শিক্ষা বোর্ডে এমন কোনো একটা নীতি থাকতে হবে, যা দিয়ে সহজেই আমরা আমাদের নাম পরিবর্তন করতে পারব। আমার আইডি কার্ডে যে ছবি তা মামুনের, অর্থাৎ ছেলেদের পোশাক পরা। এটি দেখানোর পর যখন আমার দিকে তাকায়, তখন আর কেউ ভেতরে ঢুকতে দিতে চায় না।’
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিতে পড়াশোনা করা চৈতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে চাকরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘মেডিকেল টেস্টের’ নাম করে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং তিনি শারীরিকভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
হিজড়া সামিউল আলীম শাম্মী বলেন, ‘ছেলে বা মেয়ে কোন হিসেবে বাবা-মায়ের সম্পত্তি পাব? এ বিষয়ে আইন তৈরি করতে হবে। সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকিট কাটা থেকে আমাদের লজ্জিত হওয়া শুরু হয়। ডাক্তাররা কোনো পরীক্ষা না করেই ওষুধ দিয়ে দেন। হাসপাতালে কর্মরতদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।’
হিজড়া আনোরী বলেন, ‘দেশে আইন আছে নারী ও পুরুষের জন্য। হিজড়াদের জন্য কোনো আইন নেই। থানা-পুলিশের কাছে গেলে বলে, ‘তোমাদের সমস্যা তোমরাই মিটাও।’ সরকার কি আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি?’
গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব মানুষ সমান। তবে বাস্তবতা প্রতিবন্ধকতামূলক। ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে হিজড়াদের সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে ভুল ধারণা, তা দূর করতে হবে।
কাজী রিয়াজুল হক বলেন, হিজড়াদের নিয়ে মানুষের মধ্যে যে মানসিক দৈন্য, তা কমাতে আইন করতে হবে। এই জনগোষ্ঠীর প্রাপ্যতা থেকে তাদের যারা বঞ্চিত করবে, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দলিত, হরিজন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষসহ অনগ্রসর মানুষের বৈষম্য বিলোপে আইন করার অঙ্গীকার করেছে সরকার। এই আইন দ্রুত করতে হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে কোনো যোগ্য হিজড়াকে চাকরি দেওয়া যায় কি না, তা-ও বিবেচনা করবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নুরুল কবির বলেন, দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী আছে ১১ হাজারের মতো। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পাচ্ছে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা বৃত্তি। ২ হাজার ৫০০ জন বয়স্ক পাচ্ছেন বিশেষ ভাতা। ৩৮ জেলায় ৫০ জন করে ৫০ দিনের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। ১২টি জেলায় চলছে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া। তাই হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন করা কোনো সমস্যা নয়। প্রয়োজন সদিচ্ছার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এ কে এম নূর-উন নবী আগামী জাতীয় আদমশুমারিতে নারী ও পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকার সুপারিশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর মনোজগৎ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের স্পষ্ট ধারণা নেই। পরিবারে বাবা-মাসহ অন্যরা এদের মানসিক নির্যাতন করছেন। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো জরুরি।
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান যেসব এনজিও হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছে তাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করার কথা জানান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (এইডস, এসটিডি প্রোগ্রাম) তড়িৎ কুমার সাহা বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর সেবা পেতে যে ভোগান্তি, তার মূলে আছে এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কর্মরতদের অজ্ঞতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ফরমে নারী ও পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ আছে। অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। তবে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে শুধু লিঙ্গ ও যৌনভিত্তিক পরিচয় দিয়ে বিবেচনা করলে হবে না, বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিকভাবে বুঝতে হবে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের এইচআইভি প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইজাজুল ইসলাম চৌধুরী হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে ফ্লাইওভারের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে, কিন্তু সংযুক্ত সড়কগুলো তৈরি না হওয়ায় তা কোনো কাজে লাগছে না। চিকিৎসা কারিকুলামে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়ার বিষয়টি সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, গাজীপুরে একটি পোশাকশিল্প কারখানায় ১০০ জন হিজড়াকে কাজ দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১০০ জনের মধ্যে একজনও চাকরি করেননি। হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হতে হলে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন পরিবর্তনের পাশাপাশি তাদের নিজেদেরও মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম আমানউল্লাহ হিজড়াদের ‘মেডিকেল পরীক্ষা’র বিষয়ে বলেন, এটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের হাইকোর্টের রায় আছে এ বিষয়ে।
ইউএনডিপির (চিফ অব হিউম্যান রাইটস) শর্মিলা রাসূল হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কর্মসূচিতে পরিবার, বন্ধু, শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেন। কেননা, বৈষম্যের শুরু হয় পরিবার ও স্কুল থেকেই।
নৃত্যশিল্পী সাদিয়া ইসলাম মৌ হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা ও পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম বলেন, হিজড়ারা কোনো এলিয়েন বা ভিনগ্রহের বাসিন্দা নয়। তারা কারও সন্তান, ভাই-বোন। হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সম্মানিত করা হলে তারা আর রাস্তায় গিয়ে টাকা তুলবে না। তখন তাদের আত্মসম্মানে লাগবে।