এক কথায় চা বাগানে স্বাস্থ্যঝুঁকি সমূহ:
১. প্রতি ১০০ জন চা শ্রমিকের মধ্যে দুই জন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত।
২. অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বাকার ও ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়।
৩. ৫৪ শতাংশ মায়ের গর্ভকালীন সেবা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।
৪. চা বাগানে মাতৃমৃত্যুর প্রায় ৩৯ শতাংশ।
৫. বাগানে ৫০ শতাংশ মানুষই বিশুদ্ধ পানি পায় না।
আঠারশ শতাব্দিতে উপমহাদেশে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা-চাষ শুরু হয় সিলেটে। সেই সাদাকালোর শতাধিক বছর পেরিয়ে এখন রঙিন বর্ণময় যুগে পৃথিবী। অথচ সিলেটের চা-শ্রমিকরা যেন সেই সাদাকালোর ছন্দহীন জীবনেই বাস করছেন এখনো!
নেই যুগের সাথে তাল মেলানো মজুরী, নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা, নেই চোখে পড়ার মতো স্যানিটেশন ব্যবস্থা, নেই নারী-শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তাও। এ যেন আলোর যুগে এক অন্ধকারের বসতি।
এমন ছবিই দেখা গেলো জাতীয় চা বোর্ডের অধীন সিলেটের শহর ঘেঁষা লাক্কাতুরা চা বাগানে। বৃহস্পতিবার (৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪) সরেজমিন ঘুরে যা জানা গেলো তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো।
ছড়ায় টয়লেট
লাক্কাতুরার চা শ্রমিকদের একটি বস্তির কিছু অধিবাসি টয়লেট সারেন প্রবাহিত ‘ছড়ায়’। পুরুষ, নারী সবারই একই দশা। রাত-দিন টয়লেটের স্থান ‘ছড়া’। রাতে যখন নারীদের টয়লেটের প্রয়োজন হয়, তখন পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবকদের সাথে নিয়ে যেতে হয় উন্মুক্ত ছড়ায়। যেখানে নারীরা একেবারেই অনিরাপদ। বার বার দাবী জানালেও কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করে দেয়নি টয়লেট। উল্টো সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘ঘরও দেব, বাথরুমও দেব?
কষ্টের এসব কথা বলতে বলতে চোখ ছলছল করছিলো লাক্কাতুরার এ বস্তির ১৬ বছরের কিশোরী সকাল মনির। সে জানায় দিনে কিংবা গভীর রাতে ছড়াতেই তাদের টয়লেট সারতে হয়। তার খুবই ভয় হয় যেতে। কিন্তু কিছু করার নেই।
একই আক্ষেপ সকাল মনিরের মা কুয়াশ মনিরের। তিনি জানালেন, রাত ১টা হলেও আমাদের ছড়ায় যেতে হয়। বার বার আকুতি জানালেও শুনেনা কর্তৃপক্ষ।
একই বস্তিতে থাকা পঞ্চাশোর্ধ অপর চা শ্রমিক মলিন দাসও অকপটে বললেন তাদের কষ্ট জড়ানো এসব না বলা কথা।
চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালীর সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা বললেন, বস্তিতে ৫০ ভাগও স্যানিটেশনের আওতায় আসেনি। ছড়া-ই তাদের ভরসা। ব্যাক্তি উদ্যোগে কিছু টয়লেট হয়েছে। তবে তা অপ্রতুল। দাবী জানালেও কাজ হয়না।
নলকূপের হাহাকার
সরেজমিনে লাক্কাতুরার এই বস্তিতে বিশুদ্ধ পানিরও অভাব দেখা গেছে। বেশ কয়েকটি পরিবারের নেই একটি নলকূপও। বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য তাদের যেতে হয় দূরের কোন বাড়িতে। তবে খাবার পানি দূর থেকে আনলেও ধোয়ামোছার কাজ করতে হয় পাশের সেই ছড়ায়। অথচ এই উন্মুক্ত ছড়া যেন রোগ জীবানুর আখড়া। তাই বস্তির মানুষগুলোর সারাবছরই লেগে থাকে অসুখ-বিসুখ।
কর্তৃপক্ষের কাছে কত দাবী জানিয়েছেন, এই বস্তির মানুষগুলো। কিন্তু একটি নলকূপ দিতে তাদের শত সহস্র অজুহাত।
এ নিয়ে কেবল আক্ষেপের গল্পই শুনালো কিশোরী সকাল মনি। জানালো, কত কষ্ট করে দূর থেকে পানি আনতে হয়। প্রতিদিন পানি আনতে আনতে আর ভাল লাগেনা। জান কুলিয়ে ওঠেনা। তবুও যেতে হয়।
আর মা কুয়াশ মনি বললেন, আমাদের জীবনই তো কষ্টের। এই ভাগ্য নিয়েই তো আমাদের জন্ম। আমাদের দু:খ ঘুচাবে কে?
চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালীর সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা বললেন, একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন, সেটিও যদি এ যুগে এসে সরবরাহ করা না যায়, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের কত শত সঙ্কট রয়েছে।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, চা শ্রমিকদের বসবাসরত এলাকায় প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষই বিশুদ্ধ পানি পায় না। বাধ্য হয়েই তারা ঝুঁকিপূর্ণ ঝর্ণার পানি পান করেন। ফলে প্রতিনিয়তই নানা অসুখবিসুখ তাদের লেগে থাকে।
২০১৯ সালে সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানগুলোর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম জরিপটি চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এই জরিপে দেখা গেছে,
চা বাগান হাসপাতালে সেবা অপর্যাপ্ত
সিলেটে চা বাগান বেষ্টিত অঞ্চলে প্রত্যেক চা বাগানে নেই উন্নত মানের চিকিৎসার ব্যবস্থা। প্রত্যেক চা বাগানে স্থানীয় হাসপাতালে আছে নিম্নমানের একজন কম্পাউন্ডার ও একজন মিডওয়াইফ। ছোটখাটো জ্বর, কাশি কিংবা ডায়রিয়া হলে স্থানীয় হাসপাতালের কম্পাউন্ডারের শরণাপন্ন হতে হয়। এ থেকে বড় ধরনের অসুখ দেখা দিলে চা বাগানের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয় নিজ খরচে।
লাক্কাতুরার চা শ্রমিক মলিন দাস জানালেন, বাগানে হাসপাতাল আছে। কিন্তু এখানে কোন চিকিৎসা নেই। জটিল রোগী গেলেও প্যারাসিটামল ছাড়া কিছু দেয়না।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কমিউনিটি পর্যায়ে পৌঁছালেও এবং স্বাস্থ্যসেবা দিতে বেসরকারি কিছু উদ্যোগ দৃশ্যমান হলেও তা চা বাগানের খুব কম মানুষের উপকারে আসছে। কারণ চা বাগানসমূহ এখনো বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে চা শ্রমিক ও তাদের গোষ্ঠীসমূহ সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারছে না। বেসরকারি উদ্যোগসমূহের পরিধি এখনো সীমিত। আরও যেসব কারণে তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেসবের মধ্যে অন্যতম অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং মারাত্মক বৈষম্য যার কারণে তারা অপুষ্টির শিকার এবং নিম্ন সাক্ষরতার হার তাদের মধ্যে বেশি। এসব কারণে চা শ্রমিক পরিবার দেশে অন্যান্য নাগরিকদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। সমাজে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের জন্য অনেক ক্ষেত্রে চা বাগানের নারী শ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হন।
মজুরীর হতাশা ও দারিদ্রতা
একবিংশ শতাব্দির স্মার্ট যুগে এসেও চা শ্রমিকদের সর্বোচ্চ মজুরী ১৭০ টাকা। আর সপ্তাহে তাদের দেয়া হয় মাত্র ৩ কেজি আটা। এ নিয়ে কত শত হতাশা, কত শত দু:খ চা শ্রমিকদের। আর তাদের দু:খগাথা গল্প শুনা গেলো শত বছরের প্রাচীন সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানে।
এসব চা শ্রমিকদের কারো ঘরে ৫ জনের সংসার, কারো সংসার ৮ জনের। এদের কারো ৮ জনের সংসারে রোজগার করেন ১ জন, কারো ২ জন। অথচ এর বিপরীতে তাদের দৈনিক ইনকাম ১৭০ টাকা-ই। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের বাজারে আগুন। তাই খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয় অসংখ্য চা শ্রমিকের।
এসব দুঃখগাথার গল্প বলে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন লাক্কাতুরার বাসিন্দা মলিন দাস। বললেন, বাবা খুবই অসুবিধায় আছি আমরা। অনেক দাবীর পর মজুরী করলো ১৭০ টাকা। কিন্তু বর্তমান সময়ে এটি কোন টাকা? সাথে সপ্তাহে দেয় ৩ কেজি আটা। আমার পাঁচজনের সংসার। এ টাকা ও আটা দিয়ে সংসার চালাই কিভাবে। তিনি জানালেন, অসংখ্য শ্রমিক দুই বেলা ভাত খেতে পারেনা। অনেক সময় আটাও খেতে পারেনা। মালিকরা বলে, আমরা ভালো আছি। কিন্তু কিভাবে বুঝাই, আমরা যে দারিদ্রের আঘাতে নিস্পেষিত। ধারের ভারে জর্জরিত। আমরা শিক্ষা, চিকিৎসা সহ সবকিছু থেকেই বঞ্চিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘের ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের জরিপ অনুযায়ী, সিলেটের চা বাগানের প্রায় ৭৪ শতাংশ শ্রমিক এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন।
বাংলাদেশ ইসিডি নেটওয়ার্ক কর্তৃক আয়োজিত চা বাগান ও হাওর অঞ্চলের শিশুদের বিকাশ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার হার যেখানে ৯৫ শতাংশের উপরে, সেখানে চা বাগান অঞ্চলের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার হার ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ সারাদেশের তুলনায় এসব অঞ্চলে ২০ শতাংশেরও অধিক শিশু প্রাথমিকের পূর্বেই ঝরে পড়ে। আর বাকি ১০ শতাংশ ঝড়ে পড়ে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে।
চা শ্রমিকরা জানান, চা বাগানের স্কুলগুলোতে সরকার থেকে কোনো ধরনের শিক্ষা উপকরণ কিংবা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে না । এছাড়াও স্থানীয় চা শ্রমিকরা আরও জানান, স্কুলের ফি, বইপত্র, খাতা কিনতে অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ জোগাড় করতে না পেরে অনেকেই তাদের সন্তানদের ঋণ করে লেখাপড়া করাচ্ছেন। মজুরি অনেক কম হওয়ায় চা শ্রমিকদের বলতে গেলে সবাই ঋণগ্রস্ত। তারা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেন। প্রতি সপ্তাহেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়। ফলে তাদের মজুরির টাকাও ঘরে নিতে পারেন না।
চা বাগানে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির প্রায় ৯৮টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। কিন্তু সরকারি প্রজ্ঞাপনে নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে সাঁওতাল, মুন্ডা, রাজবংশী, দেশোয়ারাসহ হাতেগোনা কয়েকটি জাতি (যারা সংখ্যায় খুব কম) ছাড়া আর কোনো জাতি অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। যার ফলে চা জনগোষ্ঠীর কেউ সরকারি চাকরি কিংবা উচ্চ শিক্ষায় নৃ-গোষ্ঠী কোটা সুবিধা পায় না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী সার্বিক বিষয়ে বলেন, একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে সকল প্রয়োজনীয় অর্থ ও উপকরণ প্রয়োজন, সেটিও যদি এ যুগে এসে সরবরাহ করা না যায়, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের কত শত সঙ্কট রয়েছে। চা শ্রমিকরা সবদিক থেকেই বঞ্চিত। তাদের ভূমির কোন অধিকার নাই। তাদের বেতন সময়ের সাথে একেবারেই বেমানান। তাদের চিকিৎসা নাই, শিক্ষাও নাই। আমরা যা খাইনা, তা তারা খেতে হচ্ছে। যা শতাব্দির লজ্জাজনক বিষয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে গত ১৭০ বছরের ইতিহাস পেছনে ফেলেছে দেশের চা শিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত চা শ্রমিক গোষ্ঠী দেশের অর্থনীতির বিরাট অংশ পূরণে বিশেষ অবদান রাখলেও তাদের অধিকাংশেরই জীবনমান নিম্নমুখী।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ‘যুবদের জন্য উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ বিষয়ক একটি কর্মশালা গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালায় বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ থেকে ৩৭জন যুব সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার বিষয়বস্তু ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদেরকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা অথবা উন্নয়ন নিয়ে যুবদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়।
এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন জনাব আহবাব মোস্তফা খান, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক জালালাবাদ।
Leave A Comment