বাংলাদেশের যুব সমাজ নানা ধরণের আর্থ-সামাজিক বৈচিত্র নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী। দেশের উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে এই যুব সমাজকেই চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্ন আলোচনায়। কিন্তু এটি অনস্বীকার্য যে,  চলমান কোভিড-১৯ অতিমারির অভিঘাত সব থেকে বেশি পড়েছে দেশের এই যুব সমাজের ওপরে। এই অভিঘাতের মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন। প্রান্তিক এবং পিছিয়ে পড়া যুব গোষ্ঠির ওপরে যার মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব এবং প্রযুক্তিগত বৈষম্য এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সর্বোপরি একটি বিযুক্ত/বিচ্ছিন্ন যুব সমাজে পরিণত করছে। যুব সমাজের এই বিচ্ছিন্নতাবোধ সমাজে নানা অসংগতি তৈরি করছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে যুবসমাজের এই বিচ্ছিন্নতাকে আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

এ প্রেক্ষিতে, গত ১১ অগাস্ট ২০২১ তারিখে, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে “বাংলাদেশের বিযুক্ত যুব সমাজ: কে, কেন এবং কীভাবে?” শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপের আয়োজন করা হয়।

সংলাপের শুবেচ্ছা বক্তব্য রাখেন নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-এর আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো, . দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন যে, বিযুক্ত/বিচ্ছিন্ন যুবসমাজ নিয়ে এই আলোচনায় চারটি বিষয়কে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে – ১) ‘‘বিযুক্ত যুব সমাজ’ একটি অর্থবহ প্রত্যয় কি না? বিযুক্ত, বিচ্ছিন্ন বা অসংযোজিত এই যুব সমাজকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়; ২) বিযুক্ত/ বিচ্ছিন্ন যুব সমাজের অন্তর্ভূক্ত কারা এবং কেনো? ৩) অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা থেকে তরুণদের বিযুক্ত/ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ পর্যালোচনা এবং ৪) গতনুগতিক যুবকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ও নীতির পাশাপাশি এই বিযুক্ত/ বিচ্ছিন্ন যুবসমাজের জন্য অর্থবহ ও কার্যকর সমাধান অনুসন্ধান। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন যে পিছিয়ে পড়া এবং বিযুক্ত যুবদের আলাদা করে দেখতে হবে।

ইউএনডিপি বাংলাদেশ-এর আবাসিক প্রতিনিধি, সুদীপ্ত মুখার্জি সংলাপের প্রারম্ভিক বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন যে, টেকসই খাদ্য উৎপাদন ও আহরণের ক্ষেত্রে যুবদের সামনে এগিয়ে আসতে হবে। করোনা বাস্তবতায় যুবদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তিনি তুলে ধরেন। বিশেষ করে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যুবদের যদি উন্নয়নের সাথে যুক্ত করতে হয় তাহলে ইন্টারনেটের আওতা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। তথ্যের প্রবেশগম্যতার উপর জোর দিয়ে তিনি মন্তব্য করেন যে, যুবদের কাছে দক্ষতা ও চাকরি সম্পর্কিত সঠিক তথ্য পোঁছে দিতে হবে।

সংলাপে আলোচক হিসাবে উপস্থিত থেকে উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা মনে করেন যে নীতি পরিকল্পনা ও আলোচনায় দেশের যুব সমাজের জন্য যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা মোকাবেলার উদ্যোগ নেই। সকল যুবগোষ্ঠীরদের সমান গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দেখার আহ্বান জানান তিনি। ট্রান্সজেন্ডার অধিকার কর্মী এবং বৈশাখী টেলিভিশন-এর সংবাদ পাঠিকা তাসনুভা আনান শিশির ও একই ভাবে পিছিয়ে পড়া যুবদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির জন্য আইন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য যে প্রয়োজন রয়েছে তার অভাবের কথা উল্লেখ করেন। যোশীয় সাংমা চিবল, প্রতিবন্ধী অধিকার কর্মী, ফিজিক্যালি-চ্যালেঞ্জড ডেভেলাপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) বলেন যে, প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য এখনও সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্য রয়েছে। তিনি মন্তব্য করেন, শিক্ষা ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য বৈষম্য দূর করার জন্য বিশেষভাবে কাজ করতে হবে। যুবদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তাদের উন্নয়নের মূল ধারায় এনে অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন শামীম আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক, ইয়ুথ এনগেজমেন্ট ফর সাস্টেনিবিলিটি (ইয়েস), বাংলাদেশ। এই ক্ষেত্রে তিনি নীতিগুলো শুধু শহরকেন্দ্রিক না রাখার সুপারিশ দেন। চা শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যের কথা বলে মোহন রবিদাস, চা শ্রমিক অধিকার কর্মী এবং সভাপতি, জাগরণ যুব ফোরাম  বলেন যে এই গোষ্ঠীর যুবদের শিক্ষা থেকে বিমুখ রাখা হয় এবং চা বাগানের বাইরের পৃথিবী থেকে তারা প্রায় বিযুক্ত তাই তারা নিজেদের কথা তুলে ধরতে পারেন না। সংলাপের আরেকজন আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জিমি আমির, প্রজেক্ট ম্যানেজার, ইএসডিজি৪বিডি, বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) এবং তিনি বিযুক্ত যুবদের সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করার সুপারিশ করেন।

সংলাপ সঞ্চালনা করেন সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পর্বে কবিতা আবৃত্তি করেন সিপিডি’র সংলাপ ও প্রচার যুগ্ম পরিচালক, অভ্র ভট্টাচার্য এবং গান পরিবেষণ করেন টনি মাইকেল গোমেজ, পরিচালক, টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম, এডভোকেসি ও যোগাযোগ, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।

এই সংলাপে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে যুব প্রতিনিধিরা, সাংস্কৃতিক কর্মী, গণমাধ্যমকর্মী, আদিবাসী, দলিত, প্রতিবন্ধি, শ্রমিক, এনজিও প্রতিনিধি, ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তা এবং সমাজকর্মী অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত তুলে ধরেন।