মূল প্রতিবেদন ডাউনলোড করতে এইখানে ক্লিক করুন
কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ সরকারের একটি গুর্রুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আওতায় বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা পরিষদ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর আওতায় শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষত যুব নারী-পুরুষদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ শেষে অংশগ্রহণকারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে কার্যক্রম শুরু করার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু কারিগরী শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ফলাফল এখনও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষার মান, হালনাগাদকরণ, বাজারচাহিদা অনুযায়ী উপযোগী কোর্স চালু করা, পাঠদান মান, পরিবীক্ষণ, ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনও অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। এছাড়াও কারিগরি শিক্ষার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও এই ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়।
বাংলাদেশে সরকারি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ বিষয়ে সিপিডি সম্প্রতি পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ ও সাতক্ষীরা জেলায় একটি সামাজিক নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া, আটোয়ারী ও সদর উপজেলায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও প্রশিক্ষক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে পরিচালিত এ নিরীক্ষা কার্যক্রমে বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে।
১৬ মে ২০২৪ তারিখে সাতক্ষীরায় মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্ট এর অডিটোরিয়ামে সিপিডি ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এর যৌথ উদ্যোগে এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এর সহযোগিতায় আয়োজিত ‘যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থানীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক সংলাপে সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে সিপিডি। এই আয়োজনের সার্বিক সহযোগিতা করেছে ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)।
সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে জনাব তৌফিকুল ইসলাম খান, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, সিপিডি। তিনি সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে বলেন—প্রাপ্ত তথ্য, সংশ্লিষ্ট বিষয়, বিশেষজ্ঞ এবং পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ থেকে এটা বলা যায় যে, কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে অগ্রগতি কম নয়। এ শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় যারা যুক্ত হয়েছেন এবং অর্জিত দক্ষতাকে পুঁজি করে উদ্যোক্তা হয়েছেন তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ সফলও হয়েছেন। এক্ষেত্রে সাতক্ষীরা এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে মধ্যম ও স্বল্পমেয়াদি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ শেষ করে অধিকাংশই চাকুরি বা আত্মকর্মসংস্থান করেছেন। সাতক্ষীরা এলাকায় পলিটেকনিক ইন্সষ্টিটিউট থাকায় স্থানীয় যুব নারী-পুরুষ কারিগরি বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন। স্বল্প-মেয়াদি প্রশিক্ষণ ও দীর্ঘমেয়াদি কারিগরি শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করে অনেকেই সফল হলেও স্থানী পর্যায়ে শিল্প-কারখানায় কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাজের সুযোগ এখনও অনেক সীমিত। এ প্রসঙ্গে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। এ সবরের মধ্যে অন্যতম হল– দরিদ্রতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, কারিগরি শিক্ষায় অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব এবং চাকুরি বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অপ্রতুলতা। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে এবং এ শিক্ষা ও দক্ষতাভিত্তিক যে সকল কর্মসংস্থান হয় সে সম্পর্কে সামাজিকভাবে একধরণের নেতিবাচক ধারনা রয়েছে।
সংলাপে ড দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি ও আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সংলাপটির সভাপতিত্ব করেন। ড দেবপ্রিয় তাঁর সূচনা বক্তব্যে বলেন—বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় ধরণের অগ্রগতি হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এমনকি উচ্চ মাধমিক ও মহাবিদ্যালয়ে নারী-পুরুষ উভয়ের ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু এই শিক্ষিত যুবসমাজ যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না। অনেকেই বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে এবং আমরা দেশের মধ্যে যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তা পূরণ করতে সক্ষম নই। আবার প্রথাগত শিক্ষার সাথে বাজারে কাজের চাহিদার সাথে মিল নেই। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ দ্রুতই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হতে যাচ্ছে। এটিকে কার্যকর করতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষা একটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, এমনকি শিল্পায়ন, কৃষির আধুনিকায়ন, সেবাখাতে ভূমিকা রাখবে বলে ইতিহাস বলে।
সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাতক্ষীরা-২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব জনাব মোঃ আশরাফুজ্জামান, এমপি। তিনি বলেন শিক্ষার সকল ক্ষেত্রেই এখন সরকার সাধারণ শিক্ষা এবং ইসলামিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি বলেন সাতক্ষীরা এক সময় পিছিয়ে পড়া জেলা হিসেবে পরিচিত থাকেলও কালের বিবর্তনে এখন অনেক এগিয়ে গেছে এবং এখনে কারিগরি শিক্ষা, কৃষি এবং মৎস চাষের ক্ষেত্রে বিকাশ ঘটেছে। শুধু যথেষ্ট বিনিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এছাড়া সাতক্ষীরায় ক্রীড়ার দিক দিয়ে, বিশেষকরে নারীরা বিশ্বদরবারে কীভাবে এগিয়ে গেছে সেই বিষয়টিও তিনি তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন।
সংলাপের বিশেষ অতিথি লায়লা পারভীন, এমপি, সদস্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ বলেন প্রতিটি জেলায় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং বর্তমানে পরিবর্তিত নতুন কারিকুলাম এর সুফল আগামী ২০ বছরের মধ্যেই দেশবাসী দেখতে পাবে। এছাড়া তিনি কারিগরি শিক্ষা বিষয়ে যথেষ্ট প্রচার প্রচারণার অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। সরকার শিক্ষা এবং যুব বিষয়ে প্রচুর কাজ করছে কিন্তু প্রচারণার অভাবে তার সুফল মানুষের কাছে পৌছাচ্ছে না।
সাতক্ষীরা টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ এর অধ্যক্ষ, জনাব মুহাম্মদ ফেরদৌস আরেফীন সম্মানিত আলোচকের বক্তব্যে বলেন কারিগরি শিক্ষা বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচকভাবে পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ ইতমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি স্থানীয় সরকার, প্রশাসনকে অধিক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানান।
সাতক্ষীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয়ে উপপরিচালক (অঃ দা) মোছাঃ এছমত আরা বেগম তার বক্তব্যে বলেন, নারীদের শুধুমাত্র পোষাক কিংবা হস্তশিল্প নয় বরং ড্রাইভিং, বেসিক কম্পিউটার কোর্স, ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড হাউজ ওইয়্যারিং এর মত কোর্সেও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পরিবার থেকে উৎসাহ এবং সাহস প্রদান প্রয়োজন।
সম্মানিত আলোচকদের বক্তব্যে জনাব মোঃ শাহজাহান কবীর, জেলা শিক্ষা অফিসার সাতক্ষীরা বলেন প্রশিক্ষণে স্থানীয় চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোর্স অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। এছাড়াও চাকরির বিজ্ঞাপনে কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে উল্লেখ থাকলে কারিগরি শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা সম্ভব বলে তিনি জানান।
সংলাপের সম্মানিত অতিথি জনাব শেখ মঈনুল ইসলাম মঈন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি), জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সাতক্ষীরা বলেন-কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়াও সরকারিভাবে এবং বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে যুবদের জন্য সাতক্ষীরায় প্রচুর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে; যেগুলোর তথ্য ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।
জনাব নজরুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ সাতক্ষীরা বলেন কারিগরি শিক্ষা একান্তভাবেই জরুরি এবং এর কোন বিকল্প নেই। দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরিতে সকল শিক্ষা ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার শাখা খোলা হয়েছে। তারা প্রশিক্ষণ পেয়ে উদ্যোক্তা হয়ে আরও জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সার্থক হচ্ছে।
জনাব মহানন্দ মজুমদার, অধ্যক্ষ, সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সাতক্ষীরা তার বক্তব্যে জাপানের উদাহরণ দিয়ে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বে কথা তুলে ধরেন।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি এবং কোর গ্রুপ সদস্য, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম তার সমাপনী বক্তব্যে আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।
এছাড়া সংলাপে উপস্থিত অংশগ্রহনকারীরা কারিগরি শিক্ষাকে জোরদার করা, স্বল্পশিক্ষিতদের জন্য কোর্স চালু করা, কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ, তাদের কাজকে মূল্যায়ন করে পূর্ণ মর্যাদা এবং মজুরি প্রদান, বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য কারগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু করা ইত্যাদি সুপারিশ উন্মুক্ত আলোচনায় তুলে ধরেন। এছাড়াও, কারিগরি শিক্ষার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সম্মানের সাথে দেখার প্রতি আহ্বান জানান উপস্থিত সকলে।
Leave A Comment