ছবিটি তুলেছেন জনাব তানজিম আহমেদ, বাগেরহাট প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল

বিভিন্ন সময় এই চরে হেনস্তা ও যৌন সহিংসতার মুখে পড়েছেন অন্তত ২০ জন নারী ও কিশোরী। পাশাপাশি কন্যাশিশুরাও রয়েছে এই তালিকায়। এছাড়া নারীদের গহনা বা সঞ্চিত অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে।

বাগেরহাট

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার কাপাসডাঙ্গা এলাকার অন্তর্গত কৈগরদাসকাঠি চরে সহস্রাধিক মানুষের বাস। রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোলঘেষা চরের বাসিন্দাদের বেশিরভাগের না আছে স্থায়ী কোনো আবাস, না আছে কর্মসংস্থান। সম্প্রতি চরে সরকারি ৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। পরিবারগুলোর চরম আর্থিক দৈন্যতায় অনেক শিশু বিদ্যালয়ে না যেয়ে নদীতে মাছ ধরে, কাজ করে দিন কাটায়। সবকিছু মিলিয়ে ক্রমশই আলোর বদলে অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ।

সরেজমিনে দেখা যায়, অল্প জায়গার উপর ছোট ছোট খুপড়ি ঘর। এমন ঘরে গাদাগাদি করে বসবাস করেন শতাধিক পরিবার। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বা ছোট খাটে শোবার পর নড়াচড়ার জায়গাও থাকে না। অনেকেরই নেই কোনো পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। মাটির চুলায় কোনোরকমে চলে রান্নার কাজ। বৃষ্টি হলে পানিতে ভিজে যায় সবকিছু। খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন।

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের সেই বিখ্যাত “আসমানী” কবিতা’র হুবহু প্রতিচ্ছবি যেন এই গ্রাম।

বাড়ি তো নয় পাখির বাসা- ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারই তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।

চরের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের সীমাহীহিন কষ্ট আর দুদ‚র্ভোগে নাকাল করুণ জীবনের গল্প।

নদীতে মাছ ধরে চলে জীবিকা: 

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কৈগরদাসকাঠি চরের মধ্যবর্তী নদী আলাদা করেছে দুই পাড়। দীর্ঘদিন ধরে এই নদীতেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন চরের বাসিন্দারা। শিশুরাও জন্মের কয়েক বছরের মধ্যে পারদর্শী হয়ে ওঠে মাছ শিকারে। একসময় নদীতে মাছ ধরে প্রায় সবার জীবিকা নির্বাহ হলেও নদীতে মাছ কমে গেছে। বর্তমানে তিনবেলা ভাত যোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। স্থানীয়দের অভিযোগ, কয়েক বছর আগে মাছ থাকলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য পানিতে পড়ার পর থেকে মাছ কমতে শুরু করে নদীতে।

নেই কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্র:

উপজেলা সদর থেকে ১২ থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই চরের পশ্চিমে পশুর নদী ও দাকোপ উপজেলা, পূর্বে কাপাসডাঙ্গা গ্রাম, দক্ষিনে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, উত্তরে বটিয়াঘাটা উপজেলা। দীর্ঘদিনেও এই এলাকায় গড়ে ওঠেনি কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য বাসিন্দাদের যেতে হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামে। গর্ভবতী মায়েদের সেবাসহ একটু জটিল সমস্যা হলেই নদী পাড়ি দিয়ে দাকোপ অথবা ১২ কিলোমিটার দূরে রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়।

হাজার মানুষের জন্য একটি নলকূপ:

সুপেয় পানির জন্য একটি মাত্র টিউবওয়েলের ওপর নির্ভরশীল পুরো চরের মানুষ। বেশিরভাগ সময় নষ্ট থাকে টিউবওয়েলটি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পানির ট্যাঙ্ক থাকলেও অন্য সবার নদী ও পুকুরের পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে পানিবাহিত নানা রোগে ভোগে শিশুসহ সব বয়সী মানুষ।

বিদ্যালয়ে নয়, শিশুরা যায় কাজে: 

কৈগরদাসকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামে ১১৩ জন শিশু রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার মত। এদের মধ্যে মাত্র ৬৪ জন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি রয়েছেন। নিয়মিত স্কুলে যায় ৩০ থেকে ৩৫জন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্য ১০৭ জন শিক্ষার্থী থাকলেও, বেশিরভাগই স্কুলে যায় না।

এই অবস্থার কারণ সম্পর্কে প্রধান শিক্ষক রেকসোনা খাতুন বলেন, বেশিরভাগ অভিভাবক হতদরিদ্র এবং লেখাপড়ার গুরুত্ব বোঝেন না। সংসারে স্বচ্ছলতার জন্য ছোট বয়সেই নদীতে মাছধরা, ইটভাটা ও বিভিন্ন হোটেলে কাজে দিয়ে দেয়।

নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নারীরা:

বিভিন্ন সময় এই চরে হেনস্তা ও যৌন সহিংসতার মুখে পড়েছেন অন্তত ২০ জন নারী ও কিশোরী। পাশাপাশি কন্যাশিশুরাও রয়েছে এই তালিকায়। এছাড়া নারীদের গহনা বা সঞ্চিত অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। প্রায়শঃই এমন ঘটনা ঘটায় নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন নারীরা।

সব মিলিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবার জন্য আবাসন, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, পানির সমস্যার সমাধান, নিরাপত্তাসহ নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতের দাবী চরবাসীর।

সার্বিক বিষয় খোঁজ-খবর নিয়ে যথাসম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন নবাগত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা।


এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ‘যুবদের জন্য উন্নয়ন সাংবাদিকতা’ বিষয়ক একটি কর্মশালা গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালায় বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ থেকে ৩৭জন যুব সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার বিষয়বস্তু ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদেরকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা অথবা উন্নয়ন নিয়ে যুবদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন জনাব তানজিম আহমেদ, বাগেরহাট প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল